সোমবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সমস্যা, তবু যাচ্ছে নারী শ্রমিক

মধ্যপ্রাচ্যে নেই মানবিক মূল্যবোধ, নারীদের মানুষ নয়, ভাবা হয় পণ্য

জুলকার নাইন

বারবার সংকট সমস্যার কথা বলার পরও মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ হচ্ছে না। সৌদি আরব, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও বৈধ ও অবৈধ উভয় পথেই নারী শ্রমিকরা যাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যে। এমনকি নিষিদ্ধ লিবিয়া ও সিরিয়াতেও যাচ্ছেন নারী শ্রমিকরা। অথচ নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রতিনিয়তই দেশে ফিরছেন ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় যাওয়া বাংলাদেশি নারীরা। আর এই নির্যাতনের মাত্রাও বাড়ছে দিনকে দিন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাই আগেই মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ কয়ে দিয়েছে ফিলিপাইন, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো। এখন সময় এসেছে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের। জানা যায়, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে ৭ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৫ জন নারীকর্মী পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছেন দুই লাখ ৩৪ হাজার ৮৩১ জন। দেশটির শ্রমবাজার আশির দশক থেকে বাংলাদেশিদের অন্যতম প্রধান কর্মস্থল। শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম, শ্রমিক কর্তৃক অপেশাদারি আচরণ, অপরাধ সংঘটন ও সেখানকার প্রচলিত আইন ভঙ্গের অভিযোগে ২০০৮ সালে সৌদি সরকার বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখে এবং অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে বিনা খরচে নারীকর্মী নেওয়ার প্রস্তাব দেয় দেশটি। নারীকর্মী পাঠালে পুরুষ কর্মী নেওয়া হবে— এমন অলিখিত চুক্তির মধ্য দিয়ে দেশের নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার কর্মীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে অগ্রাহ্য করেই বাংলাদেশ সরকার সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। মাসিক মাত্র ৮০০ রিয়াল বা ১৬ হাজার টাকা বেতনে ২০১৫ সালে গৃহকর্মী পাঠাতে রাজি হয় বাংলাদেশ। পরবর্তী সময়ে সৌদি আরব পুরুষ কর্মী নিয়োগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী নারী গৃহকর্মীর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন নিয়মিত ঘটনা। শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। ২০১১ সালে ফিলিপাইনের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দলের তদন্তে উঠে আসে, সৌদি আরবে প্রবাসী নারীকর্মীদের ওপর নির্যাতন নিত্যদিনের ব্যাপার। ফলে তারা নারীদের পাঠানো বন্ধ করে দেয়। ২০১৫ থেকে ১৭ এই তিন বছরে এক লাখ ৭২ হাজার ৫৯২ নারী সৌদি আরবে গেছেন। এর মধ্যে ফেরত এসেছেন তিন হাজার ৩৩৯ জন। সৌদি নিয়োগকর্তাদের অধীনে এসব নারীকর্মী নানা হয়রানির শিকার হয়ে সেফ হোম ও সফর জেল অথবা ডিপোর্টেশন সেন্টারে আশ্রয় নিচ্ছেন। দেশটির জেদ্দা সেফ হোমে এই তিন বছরে আশ্রয় নিয়ে দেশে ফিরেছেন এক হাজার ৬৪৮ জন এবং রিয়াদ সেফ হোমে আশ্রয় নিয়ে দেশে ফিরেছেন এক হাজার ৬৯১ জন। এসব সেফ হোমে আশ্রিত বাংলাদেশি নারীকর্মীদের দেখভাল করতে বাংলাদেশ মিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। আশ্রিত নারী কর্মীদের খাবার সরবরাহ এবং কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে বাংলাদেশ সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ৩২৪ জন নারীকর্মী সৌদি আরব থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন। আরও নারীকর্মী দেশে ফেরার অপেক্ষায় সৌদির সফর জেল ও সেফ হোমে অপেক্ষা করছেন। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্যমতে, সৌদি সেফ হোমে নিয়মিত গড়ে ২০০ জন থাকেন। শুধু সৌদি আরব নয়, সংখ্যায় কম হলেও আরব আমিরাত, জর্ডান থেকেও একইভাবে নারীকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন। কুয়েত সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী নিয়োগে স্থগিতাদেশ জারি করেছে। গৃহকর্মীদের ভিসা ইস্যুতে নানা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার অভিযোগে কুয়েত সরকার বাংলাদেশি গৃহকর্মী নিয়োগ আপাতত সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। এদিকে দীর্ঘ সাড়ে চার বছর পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার বাংলাদেশিদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে। এ বছরের এপ্রিলে দুবাইয়ে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে মূলত বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. ইসরাফিল আলম বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মানবিক মূল্যবোধের অভাব রয়েছে। সেখানে আমাদের নারীদের মানুষ নয়, পণ্য হিসেবে দেখা হয়। ২০১০ সালে এসব রিপোর্ট দেখে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘রেমিট্যান্স কমে যাক, তবু আমাদের নারী শ্রমিকদের পাঠাব না।’ এরপর বিভিন্ন দেশ থেকে কূটনৈতিক চাপ শুরু হয়। তখন একটা চাপ আসে। নারীদের না পাঠালে পুরুষ শ্রমিক নেব না। তখন আমরা নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। মেয়েরা সাপ্তাহিক ছুটি পাবেন, বিশ্রামের আলাদা জায়গা পাবেন, তারা দেশে যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন পাবেন, সৌদিতে বীমা হবে তাদের নামে। বাংলাদেশ থেকেই ভাষা  শেখানো, বিমানবন্দরে হেল্প ডেস্ক করা হয়। সেই অবস্থায় নারীদের যাত্রা আবার শুরু হয়েছে সৌদি আরবে। দুই লাখের বেশি নারী সৌদি আরব গেছেন, সাড়ে পাঁচ হাজার ফিরেছেন। নানাভাবে নির্যাতন, ধর্ষণের শিকারও হয়েছেন নারীরা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মানবিক মূল্যবোধের অভাব আছে। বায়রা’র সাবেক যুগ্ম মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, নারী শ্রমিকরা ফেরত আসছে নয়টি কারণে। কারণগুলো হলো— হোম সিকনেস, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা সমস্যা, যোগাযোগে সমস্যা, শারীরিক ফিটনেসের অভাব, কাজের অতিরিক্ত চাপ, একের অধিক বাড়িতে কাজ, মৌখিক নির্যাতন ও শারীরিক নির্যাতন।

সর্বশেষ খবর