শুক্রবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

নিখোঁজের সন্ধানে ভয়ঙ্কর চক্র

মির্জা মেহেদী তমাল

নিখোঁজের সন্ধানে ভয়ঙ্কর চক্র

ইসরাফিল হোসেন। বয়স ১৩। ময়মনসিংহ রাহমানিয়া মাদ্রাসার এই ছাত্র গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে নিখোঁজ। সকালে মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সে আর ফিরেনি। তার খোঁজে ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ করেও সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার খোঁজে এলাকায় মাইকিং হয়। বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসার মাইকেও এই নিখোঁজ সংবাদটি প্রচার করা হয়। এরপরেও তার সন্ধান না মেলায় দেশের জাতীয় পত্রিকায় ছবিসহ নিখোঁজ সংবাদের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এরপরই ইসরাফিলের সন্ধান মিলে। মাদ্রাসায় ফোন করে একজন জানায়, ইসরাফিল খুব অসুস্থ। কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। তার কোনো আত্মীয়স্বজনকে পাওয়া যাচ্ছে না। চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হলে ইসরাফিলকে জীবিত পাওয়া যাবে না। এমন তথ্য পেয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তৎপর হয়ে ওঠে। তারা যোগাযোগের চেষ্টা করে। ওই ব্যক্তি আবারও ফোন দিয়ে জানায়, বিকাশে টাকা না পাঠালে আর কিছুই করার থাকবে না। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দুবারে একটি বিকাশ নম্বরে ১২ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেয়। এরপর থেকেই সেই ফোন আর খোলা পাওয়া যায়নি।

৬৩ বছরের জয়নাল আবেদীন রামপুরায় তার আত্মীয়র বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফিরেননি। গত ৬ অক্টোবর সকাল থেকে তিনি নিখোঁজ। তার ছেলে মিলনসহ অন্যরা সব আত্মীয়স্বজনের বাসায় খোঁজ করেও সন্ধান পাননি। জয়নাল আবেদীনের ছবিসহ বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় পত্রিকায়। জয়নাল আবেদীনের ছেলে মিলন জানান, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর তাদের কাছে অন্তত চার জেলা থেকে ফোন এসেছে। তাদের প্রত্যেকেই জানিয়েছে, জয়নাল আবেদীন অসুস্থ। টাকার প্রয়োজন। বিকাশে টাকা না দিলে তাদের বাবাকে ফেরত পাওয়া যাবে না। কিন্তু তারা টাকা বিকাশে পাঠাননি। মিলন আরও জানান, যেহেতু চার জেলা থেকে ফোন এসেছে এবং তাদের প্রত্যেকের দাবি, বাবা তাদের কাছে রয়েছেন। এ কারণেই বুঝতে পারি তারা প্রতারক।

ঘিওরের এক কলেজছাত্রী শিরোনামে জাতীয় দৈনিক ও স্থানীয় পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। নিখোঁজ কলেজছাত্রীর ভাই গোপালের মোবাইল নম্বরে জনৈক ব্যক্তি নিজেকে চাঁদপুরের উত্তর মতলব থানার এসআই শিপন পরিচয় দিয়ে কল করে জানায়, তার বোনের সন্ধান পাওয়া গেছে। আপনারা দ্রুত চাঁদপুরে চলে আসেন। আপনার বোন খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে টাকা পাঠান, নইলে চিকিৎসার অভাবে আপনার বোন মারা যেতে পারে। বোনের সন্ধান পাওয়ার খবরে এবং পুলিশ পরিচয়ে তারা আশ্বস্ত হয়ে কথিত এসআই শিপনের মোবাইলে (০১৭৫৯৫৫৯১৫৭) বিকাশের মাধ্যমে ৫ হাজার টাকা পাঠায়। পরদিন ভোরে তারা কয়েকজন আত্মীয় নিয়ে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এরই মাঝে ছাত্রীর পরিবারের লোকজন কথিত ওই ব্যক্তির সঙ্গে বেশ কয়েকবার মোবাইলে কথা বলে। চাঁদপুর পৌঁছালে শিখার ভাই ওই নম্বরে কল দিলে বন্ধ পায়। ওই নম্বরে আর যোগাযোগ করতে না পেরে তারা মতলব ও চাঁদপুরের কয়েকটি থানা ও হাসপাতালে খোঁজ করলেও শিখার সন্ধান পায়নি। নিখোঁজ ছাত্রীর ভাই গোপাল জানান, একমাত্র বোনকে এমনিতেই পাওয়া যাচ্ছে না। বোনের চিন্তায় তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার ওপর আবার প্রতারণার শিকার হলাম। মানুষ এতটা অমানবিক আর প্রতারক হয় কীভাবে? একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন ঢাকার গাবতলী হাটে গরু বিক্রি করতে গিয়ে নিখোঁজ কুষ্টিয়ার কৃষক লালটুসার পরিবার। লালটুসার সন্ধান মিলেছে এবং তার অবস্থা খুব খারাপ, ওষুধ কিনতে জরুরি টাকার প্রয়োজন, এমন কথা বলে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে এমন ভয়ঙ্কর চক্র এখন সারা দেশেই সক্রিয়। এরা যে কোনো সূত্র থেকে নিখোঁজ পরিবারের ঠিকানা নিয়ে যোগাযোগ করে। এরপর নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিরা তাদের জিম্মায় রয়েছে বলে জানায়। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে কাতরাচ্ছে, টাকা না পাঠালে মারা যাবে, অজ্ঞান পার্টির খপ্পড়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে আছে—এমন সব কথা বলে নিখোঁজ পরিবারের সদস্যদের আতঙ্কিত করে তোলে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে পরিবারের সদস্যরা যখন ব্যাকুল—ঠিক তখনই সন্ধান পাওয়ার এমন সব খবর পায়। তখন টাকা পাঠাতেও কেউ চিন্তা করেন না। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিখোঁজ পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। পুলিশ বলছে, নিখোঁজ সদস্যদের সন্ধান কেউ দিলে, তা অবশ্যই পুলিশকে জানাতে হবে। পুলিশ জানতে পারলে এমন প্রতারণার শিকার হতে হবে না সাধারণ মানুষকে।

সর্বশেষ খবর