মঙ্গলবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

জিন-ভূতের কারবার

মির্জা মেহেদী তমাল

জিন-ভূতের কারবার

ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জের আবুল হোসেনের ছেলে আল আমীন দীর্ঘদিন ধরে নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন। কোনো চিকিৎসাতেই ভালো হচ্ছিল না আল আমীন। লোকমুখে গল্প শুনে আবুল হোসেন তার সন্তানকে নিয়ে যান কবিরাজ আবু তালেবের কাছে। এই আবু তালেবের নিজস্ব জিন-ভূত নাকি রয়েছে। এমন কথা মানুষের মুখে মুখে। আবুল হোসেন তার সন্তানকে আবু তালেবের হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘বাবা আপনার নাম-যশ শুনে ছুটে এসেছি আপনার কাছে। আমার প্রিয় সন্তানকে আপনি বাঁচান। আপনি ইচ্ছা করলেই আমার ছেলেকে রক্ষা করতে পারবেন।’ সব শুনে আবু তালেব কথা দেন তাকে। বলেন, তার নিজের জিন আর ভূত আছে। জিনের আধ্যাত্মিক শক্তির কথা বলে আল আমীনকে রোগবালাই থেকে চিরতরে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। তবে এর জন্য টাকা পয়সা খরচা করতে হবে। ছেলের দিকে তাকিয়ে আবুল হোসেন রাজি হয়ে যান। কয়েক দফা তার নিজস্ব অদ্ভুত পদ্ধতির চিকিৎসা দেওয়া হয় আল আমীনকে। কিন্তু দিন দিন আল আমীন আরও অসুস্থ হতে থাকে। আল আমীনের বাবা আবুল হোসেন ধৈর্য হারা হয়ে পড়েন। কিন্তু ফকির আবু তালেব উল্টো তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। কিন্তু আবুল হোসেন টাকা দেবেন না বলে জানালে ক্ষুব্ধ হন আবু তালেব। কবিরাজ আবু তালেব জিনের ভয় দেখান আল আমীনের বাবা আবুল হোসেনকে। জিনের ভয় দেখিয়ে কয়েক দফায় প্রায় ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। কবিরাজ আবু তালেব ভয় দেখিয়ে বলেন, ‘টাকা না দিলে আমার নিয়ন্ত্রণে থাকা ভয়ঙ্কর জিন আপনার সন্তান আল আমীনকে মেরে ফেলবে’। জিনের ভয়ে আবুল হোসেন নিরুপায় হয়ে একমাত্র ছেলের জীবন বাঁচাতে কয়েক দফায় ভণ্ড কবিরাজ আবু তালেবকে মোট ৮ লাখ টাকা দেন। ওই কবিরাজ আবুল হোসেনসহ আরও বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে চিকিৎসার নাম করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। আবু তালেব কখনো ইউনানী চিকিৎসক, কখনো কখনো জিনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বলে নিজেকে মহাচিকিৎসক দাবি করেন। ভণ্ড কবিরাজ আবু তালেবের বিরুদ্ধে আবুল হাসান তার ছেলের চিকিৎসার জন্য দেওয়া ৮ লাখ টাকা ফেরত চেয়ে সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দণ্ডবিধি আইনের ১০৭ ধারায় মামলা করেন। শুধু আবু তালেবই নয়, তার মতো মাদারীপুরের রেজাউল করিম সরদার পাঁচ বছর আগেও ভাড়া বাসায় থাকতেন। টেনেটুনে সংসার চালাতেন। স্বঘোষিত পীর হওয়ার পর এখন তার মাসিক আয় দশ লাখ টাকারও বেশি। রাজধানীতে রয়েছে পাঁচতলা ভবন। চলেন গাড়িতে। গ্রামের বাড়িতে কিনেছেন বেশ কিছু জমিজমা। ৩৮ বছর বয়সী সালেহ জহুর ওরফে জহুর হুজুর পাঁচ বছর আগে চট্টগ্রামের ফুটপাথে হকারি করে সংসার চালাতেন। এখন তার মাসিক আয় প্রায় ১৫ লাখ টাকারও বেশি। মাত্র পাচ বছরে তিনটি বাড়ি একটি গরুর খামারের মালিক হয়েছেন তিনি। ফরিদ উদ্দিন ওরফে কালা হুজুর, তবে এলাকার মানুষ তাকে ক্যালকুলেটর বাবা নামে বেশি চেনে। ৮ বছর আগে মসজিদের ইমামতি করতেন। আর এখন মাসে আয় করেন প্রায় ১৫ লাখ টাকা। তার নামে আছে দুটি আলিশান বাড়ি, একটি আবাসিক হোটেল এবং একটি মাছের খামার। আবদুস সালাম ওরফে ল্যাংটা ফকির, বয়স ৭০-এর কাছাকাছি। সংসার ছেড়েছেন ত্রিশ বছর আগে। এরা নিজেদের পীর দাবি করে জিন-ভূতের কথা বলে ঝাড়ফুঁকের ব্যবসা করে। আর এর মধ্য দিয়ে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আর আবদুস সালাম ওরফে ল্যাংটা ফকিরকে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি তার স্বার্থে ব্যবহার করে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। তাদের কাছে শিক্ষিত সচেতন বহু নারী স্বামী আর সংসার রক্ষার্থে ছুটে গিয়েছিলেন কথিত পীর হুজুরের কাছে। কিন্তু প্রতারণার ফাঁদে পড়ে টাকা হারিয়ে তারা প্রত্যেকে দিশাহারা। হাজারো মানুষ প্রতিনিয়ত এসব ভণ্ড পীরবাবার প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পীর-আউলিয়ার দেশ বাংলাদেশে যুগে যুগে বিভিন্ন পীর আউলিয়ার বসবাস ছিল। কিন্তু সত্যিকারের পীর আউলিয়ারা কখনো মানুষের উপকার অর্থের জন্য করতেন না। তারা মানুষের উপকার করতেন শুধু আল্লাহর প্রতি ভয় থেকে। কিন্তু বর্তমান সমাজে এমন অনেক তথাকথিত পীর আউলিয়া দেখা যায় যারা সেবার নামে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক, সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার ‘লালসালু’ উপন্যাস দিয়ে খুলে দিয়েছিলেন ভণ্ড পীরদের মুখোশ। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কিছু অদ্ভুত নামধারী অদ্ভুত পীরদের কেরামতি দেখতে হয়, দেখতে হয় শত শত মানুষের প্রতারিত হওয়ার দৃশ্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেমন সতর্ক থাকতে হবে, তেমনি সাধারণ মানুষকেও হতে হবে সচেতন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর