মঙ্গলবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

জৌলুস হারাচ্ছে বলিহার রাজবাড়ী

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

জৌলুস হারাচ্ছে বলিহার রাজবাড়ী

রাজা নেই, রাজ্য নেই। তবুও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজবাড়ী। আছে দেবালয়। সেখানে হয় না আর নিয়মিত পূজা-অর্চনা। দেবালয়ে দেবতার সন্তুষ্টিতে দেবদাসীদের নৃত্যাঞ্জলি, শঙ্খধ্বনি, পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ, ধূপের ধোঁয়া আর খোল-করতালের শব্দ থেমে গেছে বহু আগে। দেবালয়ের দুর্ভেদ্য প্রকোষ্ঠ আর দেয়াল পেরিয়ে দেবদাসীদের হাসিকান্নার শব্দ হয়তো এখনো ভেসে বেড়ায় বলিহারের ভগ্ন রাজপ্রাসাদের বাতাসে বাতাসে। উত্তরবঙ্গের ভারত সীমান্তঘেঁষা বরেন্দ্র অঞ্চল নওগাঁ  জেলা। এখানে ঐতিহ্যে ভরা ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা রয়েছে। তারই একটি বলিহার রাজবাড়ী। কালের সাক্ষী হয়ে রাজার শাসনামলের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজবাড়ীটি। এটি নওগাঁ সদর উপজেলার বলিহার ইউনিয়নে অবস্থিত।

জানা যায়, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের এক সনদ বলে নওগাঁর বলিহারের এক জমিদার জায়গির লাভ করেন। জমিদারদের মধ্যে জমিদার রাজেন্দ্রনাথ ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে বলিহারে একটি রাজ-রাজেশ্বরী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মন্দিরে রাজেশ্বরী দেবীর অপরূপা পিতলের মূর্তি স্থাপন করেন। বলিহারের নয় চাকার রথ এতদাঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল। প্রাসাদের কিছুটা দূরেই ছিল বিশাল বাগান। বাগানে এখনো রাজার শাসনামলের কিছু রোপণ করা গাছ রয়েছে। তবে বাগানবাড়িটির সামনের পুকুরঘাটের একটি ছাদ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এখানে বসত নিয়মিত জলসা। কলকাতা থেকে আনা হতো নামকরা নর্তকীর দল। বলিহারের রাজাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। রাজা কৃষ্ণেন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর একজন লেখক ছিলেন। তার লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে কৃষ্ণেন্দ্র গ্রন্থাবলী ১ম ও ২য় খণ্ড অন্যতম। দেশ বিভাগের সময় এবং জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে অন্যসব রাজার মতো বলিহারের রাজার উত্তরাধিকারী বিমলেন্দু রায় চলে যান ভারতে। এরপর প্রাসাদটি রাজপরিবারের অন্য কর্মচারীরা দেখভাল করতে থাকেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবং পরে লুট হয়ে যায় রাজবাড়ীর মূল্যবান নিদর্শন, আসবাবপত্র, জানালা-দরজাসহ বিভিন্ন সামগ্রী।

বলিহারের জমিদারিতে ৩৩০টি দীঘি ও পুকুর ছিল। এসবের নাম খুবই শ্রুতিমধুর যেমন- মালাহার, সীতাহার, বলিহার। সৌখিন রাজার ছিল মিনি চিড়িয়াখানা। সেখানে ছিল বাঘ, ভল্লুক, বানর, হরিণসহ নানা প্রজাতির পশুপাখি। জনশ্রুতি আছে, মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ বার ভূঁইয়াদের দমন করতে সৈন্যসামন্ত নিয়ে বলিহার পৌঁছেন। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করায় সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বিশ্রামের জন্য ও গুপ্তচরের মাধ্যমে বার ভূঁইয়াদের খবর জানার জন্য যাত্রাবিরতি করেন সেনাপতি মানসিংহ। ওই সময় চলছিল বরেন্দ্র অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুম। বেশি দিন বসে থাকলে সৈন্যরা অলস হয়ে যেতে পারে ভেবে মানসিংহ সৈন্যবাহিনী দিয়ে ওই ৩৩০টি দীঘি ও পুকুর খনন করেন।

রাজ ভবনটি তৃতীয় তলা। ভবনের ছাদ থেকে বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায়। প্রাসাদ কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত বিশাল দেবালয়টিতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পূজা-অর্চনা করেন। দেবালয়ের ভিতরে অনেক কক্ষ আছে। ভবনের ওপরে ওঠার দুটি সিঁড়ি আছে। প্রাসাদের পেছনের মালিপাড়ায় বিশাল আকারের দুটি শিবলিঙ্গ আছে। বিভিন্ন পার্বণের দিনগুলোতে অনুষ্ঠিত হতো নাটক, যাত্রা, কবিগান, কীর্তনসহ আরও কত কি! আটচালার নিকটতম ভবনের সিঁড়িগুলো ব্যবহৃত হতো গ্যালারি হিসেবে। মূল প্রাসাদের সামনে সতেজ দুটি গাছ আছে। নাম নাগলিঙ্গম। বর্ষা মৌসুমে গাছটিতে ফুল আসে। অবৈধ দখলে রাজবাড়ীটি ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। এখনো যদি এই রাজবাড়ীর অবশিষ্ট অংশটুকু সরকারিভাবে সংস্কার আর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় তবে ভবিষ্যতে এই রাজবাড়ীটি একটি ঐতিহ্যবাহী পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। হবে পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত।

সর্বশেষ খবর