মঙ্গলবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

খেলোয়াড়ের ছদ্মবেশ

মির্জা মেহেদী তমাল

খেলোয়াড়ের ছদ্মবেশ

তিনি একজন খেলোয়াড়। এমন পরিচয়ে সবাই তাকে চেনেন। কিন্তু তার আরও একটি পরিচয় আছে। যা অনেকেই জানতেন না। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে তার আসল পরিচয়।

পুলিশ জানতে পেরেছে, খেলোয়াড়ের ছদ্মবেশে ঢাকায় এসে নাইজেরিয়া নাগরিক প্রতারণার বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। প্রতারণার কাজে তার সহযোগী হয়েছেন বাংলাদেশেরই কয়েকজন শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। চুক্তিভিত্তিক বিয়ের কথা বলে যাদের একজনকে বেছে নিয়েছেন স্ত্রী হিসেবে। বিদেশি সাহায্য সংস্থার নামে প্রতারণার মাধ্যমে চক্রটি এরই মধ্যে মোটা অঙ্কের টাকাও হাতিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। তবে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর প্রতারক চক্রের একটি অংশকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেফতার হয়েছেন প্রতারক চক্রের মাস্টারমাইন্ড নাইজেরিয়ান নাগরিক ইমানুয়েল আসুজু।     এখন চক্রের বাকি সদস্যদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতারক চক্রের পুরো নেটওয়ার্ক চিহ্নিত করতে কাজ করছে পুলিশ। চক্রের সব সদস্যকেই আইনের আওতায় আনা হবে। সূত্র জানায়, মূলত তিনজন বিদেশি নাগরিক অভিনব কৌশলে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। তাদের মূল হোতা ইমানুয়েল আসুজুর নেতৃত্বে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে বৈঠক হয়। বৈঠকের পর ইমানুয়েল আসুজু ফুটবল খেলোয়াড় পরিচয়ে বাংলাদেশের ভিসা নেন। কিন্তু তিনি খেলোয়াড় নন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতারক চক্রের অপর দুই সহযোগীর একজন নাইজেরিয়া এবং একজন বেলজিয়াম ফিরে যান। সেখান থেকে তারা টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের মুঠোফোনে কল দিতেন। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, ইমানুয়েল একজন পেশাদার প্রতারক। এর আগেও একাধিকবার পরিচয় গোপন করে তিনি বাংলাদেশে আসেন। কখনো সাহায্য সংস্থার কর্মকর্তা আবার কখনো কূটনীতিক হিসেবে বাংলাদেশে এসে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন তিনি। এ সুবাদে এ দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও সরকারি অফিসের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে তার ভালো ধারণা আছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার গলদও প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে চক্রটি। ডিবি কর্মকর্তারা জানান, প্রতারণার সুবিধার্থে ইমানুয়েল ঢাকায় এসে লতা আক্তার নামে এক তরুণীকে চুক্তিভিত্তিক বিয়ে করেন। পরে লতাও প্রতারক সিন্ডিকেটে নাম লেখান। এ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার পর লতা আক্তার নিজেকে কাস্টমস কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন।পুলিশ বলছে, বহু লোক এ চক্রের হাতে প্রতারণার শিকার হন। তাদের মধ্যে কয়েকজন থানায় মামলাও করেন। ৩ নভেম্বর বনানী থানায় মামলা করেন স্বপ্না সরকার নামে এক নারী। মামলার এজাহারে তিনি লেখেন, ফ্রাংক উইলিয়াম নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে প্রথমে তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো হয়। এরপর ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের সফটওয়্যার হোয়্যাটস অ্যাপ দিয়ে তাদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়। এক পর্যায়ে বড়দিন উপলক্ষে উপহার পাঠানোর কথা বলেন ফ্রাংক উইলিয়াম। উপহার পার্সেলের ছবি হোয়াটস অ্যাপে তার কাছে পাঠানো হয়। স্বপ্না যখন বিদেশি বন্ধুর পাঠানো উপহার হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন, ঠিক তখনই ঢাকা কাস্টম হাউস থেকে একজন নারী কাস্টমস অফিসার তাকে ফোন করে বলেন, আপনার নামে বিদেশ থেকে একটি পার্সেল এসেছে। গিফট ট্যাক্স বাবদ ৫০ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দিতে বলেন তিনি। কিন্তু স্বপ্না একটুও বুঝতে পারেননি তিনি বড় ধরনের প্রতারণার ফাঁদে পা দিতে চলেছেন। কাজেই প্রতারকদের কৌশলের কাছে তিনি অনায়াসে ধরা দেন। পার্সেল চার্জ হিসেবে তিনি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মহাখালী শাখায় একটি অ্যাকাউন্টে ৫০ হাজার টাকা জমা করেন। এরপর পার্সেল ডেলিভারির জন্য ওই কাস্টমস কর্মকর্তার নম্বরে ফোন করলে তাকে পার্সেল না দিয়ে বলা হয়, বিদেশ থেকে পাঠানো পার্সেলে প্রচুর ডলার ও গোল্ড আছে। তাই চার্জ হিসেবে আরও ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। লোভে পড়ে স্বপ্না রানী ওয়ান ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকাও জমা দেন। কিন্তু প্রতারকরা তাকে ফের ৫ লাখ টাকা জমা দিতে বললে তিনি প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন। এ মামলার সূত্র ধরে প্রতারক চক্রের প্রধান হোতা ইমানুয়েল আসুজুকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগ। ইমানুয়েলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একে একে গ্রেফতার করা হয় কথিত কাস্টমস কর্মকর্তা লতা আক্তারসহ আরও ৫ জনকে। গ্রেফতার অন্যরা হলেন— লতা আক্তারের বোন পাপিয়া বেগম, লতার বোনের স্বামী হাবিব, হাবিবের বাবা জয়নাল আবেদীন, হাবিবের মা হামিদা আক্তার, লতার আত্মীয় রুমা আক্তার এবং রুমার স্বামী শুক্কুর আলী। খিলক্ষেত থানার নামাপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মহররম আলী বলেন, প্রতারণার কৌশল হিসেবে এ চক্রের একজন সদস্য বিদেশ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ফোন করে সখ্য গড়ে তুলতেন। ফোনালাপের সূত্র ধরে অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতেন চক্রের সদস্যরা। এরপর উপহার পাঠানোর নামে এক অভিনব ফাঁদ পাতা হতো। পুলিশ জানায়, প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের ইউনিসেফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বেলজিয়াম ও নাইজেরিয়া থেকে ফোন করা হতো। পুলিশ জানায়, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা পড়া প্রতারণার টাকার পরিমাণের ওপর ২০ পার্সেন্ট কমিশন পেতেন হাবিব। ২ থেকে ৫ হাজার টাকা অ্যাকাউন্টধারীকে দেওয়া হতো। বাকি টাকা পৌঁছে যেত প্রতারকদের হাতে। বাংলাদেশে অবস্থান করায় নাইজেরিয়ার নাগরিক ইমানুয়েলকে গ্রেফতার করা গেলেও তার বিদেশি সহযোগীদের চিহ্নিত করা যায়নি। এমনকি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদেও ইমানুয়েল তার সহযোগীদের ব্যাপারে কোনো তথ্য দেননি। ফলে নাইজেরিয়া ও বেলজিয়ামে অবস্থানরত তার অপর সহযোগীদের বিস্তারিত পরিচয় জানা যাচ্ছে না। গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত তারা অন্তত ৫০টি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান পেয়েছেন, যেগুলোয় প্রতারণার টাকা লেনদেন হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে কয়েক মাসে জমাকৃত টাকার পরিমাণ এক কোটিরও বেশি।

 

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর