শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর এক কোটিপতি চোর

♦ চায়ের দোকানের কর্মচারী থেকে কোটিপতি ♦ চুরিতে ব্যবহার করত আর ওয়ান ফাইভ এবং এক্সনজিও প্রিমিও

মাহবুব মমতাজী

তার বেড়ে ওঠা রাজধানীর বাড্ডায়। বাবা ছিল রিকশাচালক আর মা বিভিন্ন বাসা-বাড়ির গৃহকর্মী। বয়স যখন ৭ বছর, তখন সে স্থানীয় এক চায়ের দোকানে কর্মচারীর কাজ শুরু করে। এরপর রাজনৈতিক নেতাদের কার্যালয়ে চা পৌঁছে দেওয়ার কাজের এক পর্যায়ে বিভিন্ন লোকের সঙ্গে সখ্য হয়। বছর দশেক পর সে যোগ দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক হিসেবে। তার স্বপ্ন ছিল রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার। এক সময় সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়। কোনো বৈধ বা স্বীকৃত পথে নয়। রাজধানীতে সিঁধেল চুরির পথ ধরেই আজ সে কোটিপতি। কিন্তু তার চুরির কৌশল সাধারণ বেশভূষা চোরের মতো ছিল না। ৩৫ লাখ টাকার এক্সজিও প্রিমিও প্রাইভেটকারে চলাফেরা ছিল তার। এলাকায় সে এক স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। চুরি শেষে স্থান ত্যাগ করত ৫ লাখ টাকা দামের আর ওয়ান ফাইভ সুজুকি ব্র্যান্ডের মোটর সাইকেলে। খোদ রাজধানীতেই ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা বলিউডের ধুম সিনেমাকেও হার মানিয়েছে। কয়েক দফা অভিযানের পর গত ২১ নভেম্বর ভাটারা এলাকা থেকে গ্রেফতার হয় শিপন ইসলাম (৩২) নামের সেই চোর। এ সময় তার কাছ থেকে বিদেশি পিস্তল, গুলি, ল্যাপটপ ও আইফোন জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের বাড্ডা জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) আশরাফুল করিম বলেন, ছয় মাস ধরে ওই চোরের সন্ধান  চলছিল। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে এলাকাবাসী। প্রায় প্রতিদিনই ভাটারা ও আশপাশের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে দামি দামি জিনিসপত্র হারিয়ে যেত। কিন্তু এ রহস্য উন্মোচন করতেই অপেক্ষা করতে হয়েছে অন্তত এক মাস।

রড চুরি থেকে ভয়ঙ্কর চোর হয়ে ওঠা : চায়ের দোকান ছেড়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক হিসেবে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরই শিপন রডের টুকরা চুরি করা শুরু করে। এক পর্যায়ে সে রডের বান্ডিলও চুরি করে বিক্রি করা শুরু করে। কয়েক বছর পর গড়ে তোলে তিন সদস্যের সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের সদস্যরা এলাকায় ঘুরাঘুরি করে বিভিন্ন বাসা-বাড়ির সামনে রেকি করত। কয়েক দফা রেকির পর চুরির অভিযানে যেত শিপন।

যেভাবে উন্মোচন হলো চুরির রহস্য : ৬ মে ভাটারার একটি বাড়িতে ভয়াবহ চুরির ঘটনা ঘটে। বাসার জানালার গ্রিল কেটে ভিতরের আলমারি ভেঙে স্বর্ণালঙ্কারসহ সাড়ে ৯ লাখ টাকার মালামাল চুরি হয়। একই এলাকায় ২০ মে আরেকটি চুরি হয়। এ সময় ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা মূল্যের স্বর্ণালঙ্কার ও বাসার বিভিন্ন মালামাল চুরি হয়। ২৪ মে আরেক দফা চুরির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় একই এলাকার একটি বাসার ৮ লাখ ২১ হাজার টাকা মূল্যের মালামাল খোয়া যায়। জানা যায়, বাসা তিনটি ছিল সচিব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের। যে কারণে এই তিনটি মামলা নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত শুরু করে থানা পুলিশ। পুলিশের তদন্তে চুরির ধরন ও কৌশল একই বলে ধরা পড়ে। প্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনার এক মাসের বেশি সময় পর শিপনকে শনাক্ত করে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মিজানুর রহমান।

শিপনের চুরির কৌশল : চুরির আগে প্রতি সন্ধ্যা রাতে বিভিন্ন বাসা-বাড়ির সামনে শিপন ও তার দুজন লোক রেকি দিত। যে বাসার বাতি বন্ধ থাকত সেই বাসায় আরও দু-দফা রেকি দিত। তিন দফা রেকি শেষে তারা অনুমান করত যে, হয়তো ওই বাসার লোকজন ঢাকা কিংবা দেশের বাইরে রয়েছে। এরপর একজন সঙ্গী নিয়ে প্রাইভেটকার নিয়ে চুরি করতে সেই বাসায় হানা দিত শিপন। তার টার্গেট থাকত দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার বাসাগুলো। সে প্লাস ও রেঞ্জ নিয়ে জানালা কেটে বাসার ভিতরে ঢুকে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে মূল্যবান মালামাল হাতিয়ে নিয়ে সটকে পড়ত।

যত সব সম্পদের মালিক : শুধু ভাটারা এলাকাতেই ৫ বছর ধরে চুরি করে আসছিল শিপন। আর প্রতিটি বাসা থেকে চুরি করে বাসায় ফেরার আগে হাতিয়ে নেওয়া স্বর্ণালঙ্কারগুলো বাড্ডা ও তাঁতীবাজারে দুটি স্বর্ণের দোকানে বিক্রি করে দিত। চুরির টাকায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ও রূপগঞ্জে দুটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি, আর বাড্ডায় দুই কাঠা জমিও কিনেছে শিপন। এ ছাড়াও তার রয়েছে ৩৫ লাখ টাকার প্রাইভেটকার এবং ৫ লাখ টাকার মোটরসাইকেল।

যেভাবে ধরা পড়ল শিপন : চিহ্নিত হওয়ার পর থেকে ভয়ঙ্কর এই চোরকে ধরতে অন্তত ১৭ বার অভিযান চালায় পুলিশ। প্রতিটি স্থানেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উপস্থিত হওয়ার ৫ মিনিট আগে পালিয়ে যায় সে। তিন দফা অভিযানের পর পাসপোর্ট ছাড়াই ভারতে যায় শিপন। সেখানে শিলিগুড়ি পুলিশের কাছেও ধরা পড়ে। কয়েক দিন পর দেশে ফিরে এলে আবারও তার অবস্থান শনাক্ত করে গ্রেফতার অভিযান চালানো হয়। বিষয়টি বুঝতে পেরে সে ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স করে নিজেকে বড় ব্যবসায়ী দাবি করে উল্টো পুলিশের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়। এতেও রক্ষা হয়নি তার।

 সর্বশেষ ২১ নভেম্বর সকাল পৌনে ৯টার দিকে রিপনকে নিয়ে ভাটারা ঘাটপাড় এলাকায় অবস্থান করাকালে পুলিশ তাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে। পরে তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এদিকে পেশাদার আরও দুই চোর মো. বাবু ও তার বন্ধু রফিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। তারাও বাসা-বাড়িতে বাতি বন্ধ দেখলেই অপারেশন শুরু করত। ৫ মিনিটের মধ্যেই গ্রিল কাটত। এরপর ছোট্ট কাটা জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকে ২০ মিনিটের মধ্যে ঘর তন্ন তন্ন করে নগদ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। ১০ বছর ধরে প্রায় নিয়মিত গ্রিল কেটে গুলশান, বনানী, বাড্ডা, নতুন বাজার, মহাখালী, রামপুরা এলাকায় চুরি করে আসছিল। দুই বন্ধু মিলে রাজধানীতে চুরি করেছে অন্তত সাড়ে ৪০০। মালিক হয়েছে লাখ লাখ টাকার। নারায়ণগঞ্জ ও নোয়াখালীতে তৈরি করেছে বাড়িও।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর