বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

গোয়েবলস স্টোরি

মির্জা মেহেদী তমাল

গোয়েবলস স্টোরি

‘তিলকে তাল বানানো’! এমন বাগধারার ব্যবহার হরহামেশাই আমরা শুনি। কিন্তু এটা নিছক কথার কথা নয়। আমাদের চারপাশে এর নজিরও মেলে। জোসেফ গোয়েবলস এমনই এক ব্যক্তি যার নাম নিলে আর বলতে হয় না  প্রপাগান্ডা বা অতিরঞ্জিত শব্দগুলো। আমাদের দেশেও প্রচলন আছে  ‘গোয়েবলসীয়’ শব্দটি। তিনি ছিলেন জার্মানির একনায়ক হিটলারের প্রচারমন্ত্রী। যা কস্মিনকালেও ঘটার সম্ভাবনা নেই, এমন ঘটনা ঘটেছে রব তুলতে যার জুড়ি ছিল না। শুধু ভাষণ-বক্তৃতায় নয়, খোদ রেডিও-খবরের কাগজে গুজবের বেসাতি ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেওয়া ছিল তার মূল লক্ষ্য। হালে বাংলাদেশে গুজব ছড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা ওয়েবসাইট পেজ। সাধারণ মানুষ গুজবে কান দিয়ে ভয়ঙ্কর সব ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিল। ২০১৩ সালের ৩ মার্চ বগুড়ায় গুজব ছড়ানো হয়, সরকার জামায়াত নেতা সাঈদীকে গোপনে ফাঁসি দিয়েছে। এর পর তাকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে। তারা মসজিদের মাইকে এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এমন গুজব ছড়িয়ে ধর্মভীরু জনগণকে  ঘর থেকে ডেকে বাইরে আনে। ফজরের নামাজের পর লাঠিসোঁটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে জামায়াত ও বিএনপির শত শত কর্মী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বাণিজ্য মেলা, স্টেশন, সদর থানা, ফুলবাড়ী, উপশহর, নারুলী, কৈগাড়ী ও স্টেডিয়াম ফাঁড়ি, মোকামতলা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশের ওপর হামলা হয়। সরকারি অফিসগুলো হামলাকারীর নিশানায় পরিণত হয়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ১৩ জন নিহত হয়েছিল দুদিনে। পরিকল্পিতভাবে এই গুজব ছড়িয়ে দেশের পরিস্থিতি অশান্ত করে দেওয়া হয়েছিল। গত আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয় গুজব ছড়িয়ে। ফেসবুক লাইভে এসে অভিনেত্রী-মডেল কাজী নওশাবা আহমেদ নিজেই গুজব ছড়িয়ে বলেছিলেন, জিগাতলায় একজন শিক্ষার্থীর চোখ তুলে ফেলা হয়েছে ও চার শিক্ষার্থীকে মেরে ফেলা হয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে তার এসব তথ্যের কোনো সত্যতা পায়নি পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ও উসকানিমূলক বক্তব্য ছড়ানোর অভিযোগে আইসিটি আইনে ওইদিন রাতেই উত্তরা থেকে গ্রেফতার হন অভিনেত্রী নওশাবা। গ্রেফতার হওয়ার পরে নওশাবা দাবি করেন, তিনি নিজের চোখে এসব ঘটনা ঘটতে দেখেননি। অন্যের মুখে শুনে তিনি পরে ফেসবুকে এসব তথ্য শেয়ার করেছিলেন। ২ নভেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর ও উসকানিমূলক লেখা এবং ভিডিও পোস্ট করায় দুজনকে গ্রেফতার করেছে সিটিটিসির সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং টিম। সিলেটের শাহপরান থেকে আবুল হাসান এবং কুমিল্লার মেঘনা থেকে আবদুল্লাহ আল-মামুনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজ ও অনলাইন পোর্টালের অ্যাডমিন। যেখানে দেশি ও বিদেশি ব্যক্তিবর্গের নির্দেশ ও সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ এবং রাষ্ট্রবিরোধী মিথ্যা ও উসকাানিমূলক লেখা, ছবি এবং ভিডিও অপপ্রচার করা হয়। যা রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে। যা দেখলে বা শুনলে যে কেউ নীতিভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারে বা জনশৃঙ্খলা বিঘিœত করতে পারে। গত ৩০ অক্টোবর ঢাকার কাফরুল থেকে মোরশেদ আলম মিয়াজী নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ। যিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবে নিজস্ব চ্যানেল খুলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মিথ্যা তথ্য প্রচারের মাধ্যমে বিদ্বেষ সৃষ্টি করছিলেন। গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে ইউটিউবে টিভি চ্যানেল পরিচালনার বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস জব্দ করা হয়। শুধু এ কটি ঘটনাই নয়, গুজব ছড়ানোর মহলটি দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

সত্য লুকাতে বা দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে আজগুবি কিছু ছড়ালে তা দুনিয়াব্যাপী ‘গোয়েবলস স্টোরি’ নামে পরিচিতি পেয়ে আসছে। দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ছড়ানো হয়েছে নানা ধরনের গুজব, যাকে অনেকে বলছেন ‘গোয়েবলস স্টোরি’। এসব গুজবে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতিসহ রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সেলিব্রেটিদের নাম জড়ানো হচ্ছে। মিথ্যা তথ্য দ্রুত ইউটিউব, ম্যাসেঞ্জার, ও হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কোনো গুজবে সশস্ত্র বাহিনীর মতো সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানের নামও ব্যবহার করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুজবের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা না গেলে সমাজে নানা সন্দেহ ও সংশয় বাড়বে। বিশ্বাস-অবিশ্বাস ও সন্দেহের দেওয়াল শক্ত হবে। এমনকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। নিকট অতীতে যার একাধিক উদাহরণ রয়েছে। নাসিরনগরে তা ব, কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের পর চাঁদে তাকে দেখা ও সড়ক দুর্ঘটনা রোধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। গত ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ঘিরে একটি চক্র গুজব ছড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। র‌্যাবের অভিযানে তা ভেস্তে যায়। তারা স্টুডিও ভাড়া নিয়ে গুজবের কনটেন্ট  তৈরি করত। ইচ্ছা মতো ডকুমেন্টারি আকারে ভিডিও কনটেন্ট এবং প্যারোডি গান তৈরি করে ফেসবুক ও ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছিল তারা। এরা সবাই ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। গত ২৮ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর মগবাজার ও মৌচাক এলাকায় অভিযান চালিয়ে শিবির নিয়ন্ত্রিত সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠীর তিন সদস্যসহ ৮ জনকে আটক করে র‌্যাব-২। গুজব ছড়ানোর বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন করে সহায়তা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। পুলিশ সদর দফতর জানায়, স্বার্থান্বেষী মহলটি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য, সংবাদ, পোস্টার, লিফলেট, বক্তব্য, ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রকাশ ও প্রচার করছে। এতে জনমনে নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। গুজবকে কেন্দ্র করে স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোরও চেষ্টা করা হয়ে থাকে। গুজবের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে ও সাধারণ মানুষকে গুজবের সত্যতা যাচাইয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ নম্বরের সহায়তা নেওয়া যাবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্য কোনো মাধ্যমে প্রকাশিত কোনো বিষয় গুজব মনে হলে বিভ্রান্ত না হয়ে সত্যতা যাচাইয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ নম্বরে কল করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর