শনিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ নিয়ে নতুন পরিকল্পনা সরকারের

জিন্নাতুন নূর

এক দশক আগেও বিদ্যুতের জন্য হাহাকার করতে হতো দেশের মানুষকে। গ্রাহকদের সঙ্গে বিদ্যুৎ যেন লুকোচুরি খেলত। প্রতি ঘণ্টা পর পর বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় গ্রাহকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। সে সময় বিদ্যুৎ সংকটের কারণে শুধু যে নাগরিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা নয়, থমকে গিয়েছিল কলকারখানার উৎপাদনও। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহে বিশাল ঘাটতির কারণেই এমনটি হয়েছিল। কিন্তু এক দশক পর ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ স্লোগানে উজ্জীবিত বিদ্যুৎ বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা বিদ্যুৎ খাতের গোটা দৃশ্যপট একেবারে বদলে দিয়েছে। এখন শুধু শহরাঞ্চলই নয়, বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হচ্ছে গ্রামীণ জনপদও। বিদ্যুতের জাদুর ছোঁয়ায় চাঙ্গা হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। বিদ্যুৎ, খনিজ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, চলতি বছরের জুনেই দেশের শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ সম্পন্ন হবে। এর মাধ্যমে দুই মেয়াদে থাকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের জনগণের কাছে করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে এবার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর পাশাপাশি বেশ কিছু নতুন লক্ষ্যমাত্রাও ঠিক করেছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর এত স্বল্প সময়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার শতভাগ বিদ্যুতায়ন কাজটি শেষ করতে চাচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আওয়ামী লীগ সরকার এবার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে একগুচ্ছ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এগুলো হচ্ছে- ২০২৩ সালের মধ্যে ২৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ২৩ হাজার সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, ২০২০ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিতকরণ, ২০২৩ সালের মধ্যে প্রায় ৫ লাখ কিলোমিটার বিতরণ লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, মহেশখালী ও মাতারবাড়ী অঞ্চলে একটি এবং পায়রাতে একটি করে এনার্জি হাব গড়ে তোলা। এ ছাড়া গত মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু কাজ সম্পন্ন করেছে এবং কিছু কাজ এখনো চলমান। সম্পন্ন এবং চলমান কাজগুলো হলো- পুরনো ও অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্র পাওয়ারিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক ৫১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ৫২ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি-২০১৬) প্রণয়ন, সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ৮ হাজার সার্কিট কিলোমিটার থেকে ১১ হাজার ১২৩ সার্কিট কিলোমিটার উন্নীতকরণ, গ্রিড সাবস্টেশন ক্ষমতা ১৫ হাজার ৮৭০ এমভিএ থেকে ৩৬ হাজার ৪৬ এমভিএতে উন্নীত করা, ২০২১ সালের মধ্যে ১০ হাজার সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ, গ্রাহক সংখ্যা ১ কোটি ৮ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি ১৮ লাখে উন্নীত করা, বিতরণ লাইন ২ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার থেকে ৪ লাখ ৫৭ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারণ, সামগ্রিক সিস্টেম লস ১৬.৮৫ শতাংশ থেকে ১১.৪০ শতাংশে হ্রাস, ঢাকার বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা আন্ডারগ্রাউন্ডে রূপান্তরকরণের উদ্যোগ গ্রহণ, গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ খাতে অভিযোগ ব্যবস্থাপনা চালু, বিদ্যুৎ খাতের বিশাল বিনিয়োগ অর্থ জোগানে এডিপি ব্যতীত বেসরকারি বিনিয়োগ ও ইনোভেটিভ ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল আইন ২০১৫’ প্রণয়ন, ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা, পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ী ও মহেশখালীতে কয়লাভিত্তিক সর্বমোট ৯ হাজার ৯৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৮টি মেগা প্রকল্প গ্রহণ। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট, আর ২০১৮ সালে এসে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হয়েছে ২০ হাজার ৭৭৫ মেগাওয়াট। গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৬২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। আবার ২০০৯ সালে দেশে যেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৭টি, ২০১৮ সালে সে সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১২২টিতে। বর্তমানে পল্লী বিদ্যুতের সমিতিগুলো প্রতি মাসে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছে। আগে বিদ্যুতের মিটার পাওয়া কষ্টকর হলেও শতভাগ বিদ্যুতায়ন কর্মসূচি গ্রহণের পর এখন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান দ্রুত ও সহজতর হয়েছে। এমনকি সৌর বিদ্যুতের কারণে এখন দুর্গম গ্রামীণ জনপদও সন্ধ্যার পর হয়ে উঠছে আলোকিত। অন্যদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৩ হাজার ৬৫৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৫৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন। এ ছাড়া বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ভারত থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের ভূখ- ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটান থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানি প্রক্রিয়া আরও সহজ হয়েছে। ভারতের আন্তসীমান্ত বিদ্যুৎ আমদানি-রপ্তানি নির্দেশিকা ২০১৮ এর সংশোধনের ফলে এমনটি  হয়েছে।

বছরের প্রথম দিনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, চলতি বছরের জুনের মধ্যেই দেশের সব গ্রাহক বিদ্যুৎ সংযোগ পাবেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ৯৪ ভাগ এলাকা বিদ্যুৎ সরবরাহের নেটওয়ার্কে এসেছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়ার কর্মসূচি প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। তবে নিরবচ্ছিন্ন সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সরবরাহই হবে আগামীর চ্যালেঞ্জ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারা দেশে শতভাগ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিতে বিদ্যুৎ খাতেও চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। বিদ্যুৎ বিভাগ ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) কর্তৃপক্ষ প্রত্যন্ত গ্রামগুলো আলোকিত করার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এতে বিদ্যুতের সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ও গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক দশকে কমেছে বিদ্যুতের সিস্টেম লসের হারও।  বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী জানান, নিরবচ্ছিন্নভাবে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎ খাতে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধিতে উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। এ মুহূর্তে এ খাতে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা গেলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে। সম্প্রতি ভারতের আন্তসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্য নীতিমালা সংশোধন করে প্রতিবেশীদের তাদের ভূখ- ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছে। এতে বাংলাদেশ আরও সাশ্রয়ী মূল্যে ভারতের বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারবে। একই সঙ্গে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যে আন্তদেশীয় গ্রিডলাইন নির্মাণ করা হবে, তা দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ এই দুটি দেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে পারবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর