রবিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

এ মাসেই দৃশ্যমান পদ্মা সেতুর এক কিলোমিটার

লাবলু মোল্লা, মুন্সীগঞ্জ

এ মাসেই দৃশ্যমান পদ্মা সেতুর এক কিলোমিটার

সর্বপ্রথম পদ্মা সেতুর কথা মাথায় এনেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্য কোনো সরকার বা কোনো ব্যক্তি নয়। সম্প্রতি একটি প্রথম শ্রেণির জাতীয় দৈনিক বলেছে, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথম পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরও বহু আগে ২০০১ সালের ৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়ার পদ্মাপারের মৎস্য আড়তের কাছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। এতে এটা প্রমাণিত যে, পদ্মা সেতুর কথা প্রথম ভেবেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালে একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়চেতা মনোবলে ঘোষণা দেন, পদ্মা সেতু নির্মিত হবে নিজেদের টাকায়। যেমন কথা তেমন কাজ। শুরু হয় দেশবাসীর বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ। এরই ধারাবাহিতায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী সিপাহশালার হিসেবে নিয়োগ দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে। এরপর ওবায়দুল কাদের দিনরাত ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে দেড় শতাধিক বার এই প্রকল্পে ছুটে আসেন। ৬.১৫ মিটার দীর্ঘ এ সেতুর ৪২টি পিলারে বসার কথা ৪১টি স্প্যান। দেশবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দেখা মেলে ১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। ওই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় আরও একটি মাইলফলক রচনা করে। সেদিন জাজিরা প্রান্তে ৩৭-৩৮ নম্বর পিলার দুটির ওপর প্রথম স্প্যানটি স্বপ্ন ভেঙে ডানা মেলে উঠে দাঁড়ায়। এরপর একে একে আরও ৪টি স্প্যান বসে একত্র হয় পাঁচটি স্প্যান, যার দৈর্ঘ্য সাড়ে ৭০০ মিটার। ৬ নম্বর স্প্যানটি মাওয়া প্রান্তে বসেছে। এখানে আরও তিনটি স্প্যান পিলারে ওঠার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এদিকে ৭ নম্বর স্প্যানটি জাজিরা প্রান্তে এ মাসেই বসবে। আর ফেব্রুয়ারিতে বসবে ৮ নম্বর স্প্যান। এতে জাজিরা প্রান্তে একসঙ্গে সাতটি স্প্যান পিলারে বসে দেখা মিলবে এক কিলোমিটারের বেশি পদ্মা সেতু। এ ছাড়া সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হয়ে নান্দনিক দৃশ্যে মাওয়া প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে টোলপ্লাজা।

পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব বিষয়ে নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, সব ঠিক থাকলে এ মাসে একটি এবং আগামী মাসে আরও একটি স্প্যান পিলারে বসানো হবে এবং এতে এক কিলোমিটারের বেশি সেতু দৃশ্যমান হবে। তেমনিভাবে মাওয়া প্রান্তেও বেশ কয়েকটি স্প্যান প্রস্তুত এবং কয়েকটি পিলার প্রস্তুত হওয়ার পথে। সেখানেও শিগগিরই একযোগে আরও কয়েকটি স্প্যান বসানো হবে। এদিকে প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত মালামাল মানসম্মত না হলে তা ব্যবহার করা হচ্ছে না। পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত মালামালের গুণগত মান অন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। তিনি আরও জানান, বর্তমান সময় পর্যন্ত মূল সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৭২ ভাগ। আর সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৬২ দশমিক ৫০ ভাগ। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতু কিছুদিনের মধ্যেই এক কিলোমিটার দৃশ্যমান হতে চলেছে। সার্বিক নিরাপত্তায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশও ভূমিকা রাখছে। এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম পিপিএম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের সর্ববৃহৎ এই সেতুর কাজ নিজস্ব অর্থায়নে করা হচ্ছে। জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বুদ্ধিমত্তার কারণে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ হাতে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। এখানে কর্মরত সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পুলিশের অন্যতম কাজ। পুলিশ সদা সচেষ্ট। এ সেতুর দুই পারেই দুটি থানা প্রস্তুত, এখন শুধু অপেক্ষা উদ্বোধনের। এ নিয়ে পদ্মাপারের মানুষের মধ্যে রয়েছে উৎসবের আমেজ। তিনি বলেন, শত বাধা-বিপত্তি পার করে দেশবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হবেই। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার তথা সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ নিশ্চিত হবে। উন্মোচিত হবে নতুন দিগন্ত। আর এ কারণে দেশের দক্ষিণবঙ্গের কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে মুন্সীগঞ্জবাসী আনন্দে উদ্বেলিত। পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (নদী শাসন) শারফুল ইসলাম জানান, এ প্রকল্পে মাওয়া প্রান্তে প্রায় ২ কিমি. ও জাজিরা প্রান্তে প্রায় ১২ কিমি. নদী শাসনের কাজ চলছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড মাওয়া প্রান্তে আরও ৪ থেকে ৬ কিমি. নদী শাসনের কাজ করবে। পদ্মা সেতুর কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নদী শাসনের জন্য দায়িত্বে রয়েছেন চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। মূল সেতুর নির্মাণকাজের জন্য চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। সেতুর দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ, টোল প্লাজা ও অন্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য যৌথভাবে আবদুল মোনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়ার হাইওয়ে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট কাজ করে চলেছে।

দেশবাসীর বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে জনমনে আশার আলো জ্বলতে শুরু করেছে। আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে এ সেতু। বিনিয়োগকারী ও পর্যটকদের জন্য দৃষ্টিনন্দন হবে পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা। এই প্রকল্পের কারণে স্থানীয় উন্নয়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এ অঞ্চল ঘিরে আলাদা একটি শহর গঠিত হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণসহ এ অঞ্চলে আরও ব্যাপক উন্নয়নের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আওয়ামী লীগ সরকার ছাড়া অন্য সব সরকারের আমলেই দক্ষিণবঙ্গ অবহেলিত ছিল। পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হলে অবহেলিত থাকবে না এ অঞ্চল আর এখানকার মানুষ। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি হবে দক্ষিণবঙ্গের। দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনেও পদ্মা সেতু ভূমিকা রাখবে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পদ্মা সেতু পৃথিবীর অন্যতম একটি সেতু হিসেবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে স্থাপন করতে যাচ্ছে সড়ক ও রেল যোগাযোগ। কংক্রিট আর স্টিলের নিখুঁত গাঁথুনিতে তৈরি হতে যাচ্ছে বিশ্বের অতুলনীয় এই দোতলা  সেতু। দেশি-বিদেশি ২২ হাজার শ্রমিক আর প্রকৌশলীর অক্লান্ত পরিশ্রমে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে সেতুর মূল নির্মাণকাজ।

সর্বশেষ খবর