মঙ্গলবার, ৮ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

অপরাধী একজন জেলে আরেকজন

মির্জা মেহেদী তমাল

অপরাধী একজন জেলে আরেকজন

মধ্যরাতে পুলিশের দল অভিযান চালায় রেবতী জলদাসের বাড়িতে। পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলে পুলিশ। দরজায় আঘাত করে তারা। ঘুম ভেঙে যায় বৃদ্ধ রেবতী জলদাসের। তিনি দরজা খুলে দিলে পুলিশের দল বাড়ির ভিতর ঢুকে তল্লাশি শুরু করে। জলদাস তাদের কাছে জানতে চায় ঘটনা। পুলিশ বলে, অমর দাস কোথায়? রেবতী জলদাস জানায়, অমর দাস তার ছেলে। পাশের রুমে ঘুমিয়ে আছে। পুলিশ এ কথা শুনেই পাশের রুমে গিয়ে অমর দাসকে জাগিয়ে তোলে। তারা তাকে হাতকড়া লাগিয়ে বাইরে বের করে আনে। জলদাস জানতে চান, তার ছেলের অপরাধ কী? পুলিশ বলে. আপনারা ভালোই জানেন। আপনার ছেলে দাগি আসামি। জেলফেরত আসামি। এ কথা শুনে জলদাস হতবাক। অবাক হয় অমর দাসও। কী বলেন স্যার! আমার ছেলে অপরাধী হবে কেন? জীবনেও জেল খাটেনি, বলতে থাকে জলদাস। জলদাস এও বলে, তার ভাইয়ের ছেলে স্বপন দাস অপরাধী। সে জেল খেটেছিল। কিন্তু আমার ছেলে জেল খাটেনি কখনো। কিন্তু পুলিশ কোনো কথাই শুনছে না। তাকে বাড়ি থেকে টেনে বাইরে বের করে। গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। পুলিশের হাঁকডাক চেঁচামেচিতে পাড়ার লোকজনের ঘুম ভাঙে। তারা বেরিয়ে এসে পুলিশকে অনুরোধ করে। অমর দাস ভালো লোক। অপরাধী নয়। কিন্তু পুলিশের কাছে কাগজপত্র ছিল। অমর দাসের নাম লেখা স্পষ্ট। একটি নয়, দুটি মামলায় ওয়ারেন্ট রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তা দেখিয়ে পুলিশ বলে, এই যে কাগজপত্র আমাদের কাছে রয়েছে। তার বিরুদ্ধে হুলিয়া বেরিয়েছে। আদালতের নির্দেশ। তাকে গ্রেফতার করতে হবে। এ কথা বলেই পুলিশ অমর দাসকে নিয়ে চম্পট। ঘটনাটি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার উত্তর বামনডেঙ্গা গ্রামের। আদালতের পরোয়ানা অনুযায়ী গত ২০১৮ সালের ৫ জুলাই অমরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের কারণে হতবাক হয়ে যান অমর। তিনি সে সময় পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি এর আগে কখনো গ্রেফতার হননি। তবে পুলিশের খাতায় অমর দাসের তিন বছর জেল খাটার কথা উল্লেখ রয়েছে। ওই সময় অমর দাস পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। পুলিশ নিশ্চিত, তিনি নিজেকে বাঁচানোর জন্য ‘নাটক’ করছেন। এরপর আদালতের মাধ্যমে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। জেলে পাঠানোর পর আগে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির সঙ্গে অমরের শনাক্তকরণ চিহ্ন মিলাতে গিয়ে পুলিশ দেখতে পায় সেটা মিলছে না। অর্থাৎ গুলির চিহ্ন নেই অমর দাসের পায়ে। পুলিশ দ্বিধায় পড়ে। একই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি মতিনের কাছে বিষয়টি জানতে চান তারা। মতিন ২০০৪ সালে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি আর অমর এক ব্যক্তি নয় বলে তিনি জানান। এরপর আদালত থেকে তাদের মুখোমুখি করার অনুমতি চাওয়া হয়। আদালতের নির্দেশ পেয়ে অমরের মুখোমুখি করে মতিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন মতিন জানায়, তাদের সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি ও বর্তমানে গ্রেফতার অমর এক ব্যক্তি নয়। আগে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির ডান পায়ে গুলির জখম ছিল। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ অভিযান শুরু করে। অভিযানে গত ১৩ আগস্ট কদমতলী এলাকা থেকে প্রকৃত আসামি স্বপন দাসকে গ্রেফতার করে পুলিশ। স্বপন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তার নাম গোপন করে চাচাত ভাইয়ের নাম দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে। জানা যায়, ২০০৪ সালের ১৬ আগস্ট র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের পর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার করা হয় স্বপন দাশ ও তার সহযোগীসহ পাঁচজনকে। বন্দুকযুদ্ধে স্বপনের পায়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তিনি পঙ্গু হয়ে যান। সে সময় নাম-পরিচয় বদলে নিজেকে তার চাচাত ভাই অমর দাস হিসেবে পরিচয় দেন স্বপন। তিন বছরের মাথায় ২০০৭ সালে জামিনে ছাড়াও পেয়ে যান তিনি। এরপর থেকে পলাতক। এ মামলায় ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে পাঁচ আসামিকে ২২ বছরের কারাদ  দেয় আদালত। গত বছর ৫ জুলাই অস্ত্র মামলায় অমরকে গ্রেফতার করেছিল সদরঘাট থানা পুলিশ। অমর একজন সুইপার। তার পরিবার অসহায়। দিনে আনে দিনে খায় অবস্থা। বিষয়টি জানতে পারেন সদরঘাট থানার ওসি নেজাম উদ্দিন। পরে কারাবন্দী অমর পুলিশের সহযোগিতায় হাই কোর্ট বিভাগে রিট করেন। গত বছর ২৮ অক্টোবর বিচারপতি হাবিবুল গণি ও বিচারপতি বদরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ অমরকে সাজার দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদেশ দেন। শুধু অমর দাস নয়, এমন অনেক নিরপরাধ মানুষ বিনা দোষে জেল খাটছেন। কখনো পুলিশের ভুলে, আবার কখনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিনা দোষে কারাভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশকে আরও সচেতন হতে হবে। তদন্ত করে দেখতে হবে, প্রকৃত আসামি কে?

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর