বৃহস্পতিবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

শ্রদ্ধা ভালোবাসায় বিদায় বুলবুলকে

সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক

শ্রদ্ধা ভালোবাসায় বিদায় বুলবুলকে

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে অগণিত মানুষের ভালোবাসা আর ফুলেল শ্রদ্ধায় চির বিদায় জানানো হয়েছে কালজয়ী সুরস্রষ্টা মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। সুরের বাঁধনে এ দেশের অগণিত সুরানুরাগীর হৃদয়ে নিজের জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে কিংবদন্তির এ প্রস্থানটা ছিল রাজসিক। গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বসাধারণের ফুলেল শ্রদ্ধা শেষে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন এই মুক্তিযোদ্ধা। এর আগে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের হিমঘর থেকে বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয় তার মৃতদেহ। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় সেখানে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ভক্তানুরাগী, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ। ফুলেল শ্রদ্ধার পাশাপাশি ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান করা হয় এই শিল্পীকে। শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বের শুরুতেই আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের নেতৃত্বে অন্য নেতা-কর্মীরা।

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সহকারী সামরিক সচিব ইফতেখারুল আলম। শ্রদ্ধা জানান তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান ও উপ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদ, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপু, সংস্কৃতিকর্মী শংকর সাঁওজাল, শিল্পী সুমনা হক, শফিক তুহিন, ম. হামিদ, মনির খান, এস ডি রুবেল, শুভ্র দেব, রিজিয়া পারভীন, শাহেদ, ফুয়াদ নাসের বাবু প্রমুখ।

প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, নজরুল সংগীতশিল্পী পরিষদ, ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুল, এলআরবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, জাসাস, অ্যাডাব, উদীচী, স্রোত আবৃত্তি সংসদ, বাংলাদেশ বৌদ্ধ যুব পরিষদ, দেশ টিভি, আনন ফাউন্ডেশন, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, আজিমপুরের গেরিলা বাহিনী, সজীব গ্রুপ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু ঐক্যজোট, গণসংহতি আন্দোলন, চারুশিল্পী সংসদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, শিশু একাডেমি, প্রাচ্যনাট, বাংলাদেশ বেতার প্রভৃতি সংগঠন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছেলে সামির আহমেদ বলেন, তিনি দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তারাই তার গানকে বাঁচিয়ে রাখুক। পরিবারের পক্ষ থেকে আর কিছুই চাওয়ার নেই। তাকে যে শ্রদ্ধা করা হয়েছে, তিনি তার যোগ্য দাবিদার। গীতিকার সুরকারের চেয়ে বড় কথা তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সে হিসেবে দেশের জন্য যা করা প্রয়োজন তিনি তা করেছেন। এবার দেশের মানুষের কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের পরিবারের দাবি ছিল ‘মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের। প্রধানমন্ত্রী সে দাবি পূরণ করেছেন, এর জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, তার চলে যাওয়া এ দেশের জন্য বড় ক্ষতি। তার সব সৃষ্টিকর্ম সরকারের পক্ষ থেকে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ হবে। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, তার মৃত্যুতে শুধু দেশের সংগীতাঙ্গন নয়, সমগ্র জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হলো। তার সৃজনকর্ম সংরক্ষণের জন্য যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হবে।

মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, তিনি শুধু গানের জন্য নয়, দেশের প্রতি যে অবিস্মরণীয় ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা ভোলার নয়।

২০১২ সালে গঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন তিনি। যার কারণে পরবর্তী সময়ে তার ভাই প্রাণ হারান।

সৈয়দ আবদুল হাদী বলেন, সংগীত সম্পর্কে আধুনিক চিন্তাভাবনা ছিল তার। স্বাধীনতার পর নতুন সংগীত চিন্তা নিয়ে যারা কাজ শুরু করেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তাদের অন্যতম।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, তার গুণকীর্তন করার প্রয়োজন পড়ে না। তার গান তার পরিচয়। তিনি চলে গেলেন কিন্তু তাকে মূল্যায়ন সম্মান করার দায়িত্ব আমাদের, রাষ্ট্রের।

সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, দেশের গান যে এভাবে প্রাণ ছুঁয়ে যেতে পারে- তা বুলবুলের গান গাওয়ার সুযোগ না হলে উপলব্ধি করা সম্ভব হতো না। তিনি পৃথিবীর নিয়মে চলে গেছেন, কিন্তু আমাদের হৃদয়ে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।

নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, যে বিশ্বাস নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, সেই বিশ্বাসে আমৃত্যু অটল ছিলেন। তার সেই বিশ্বাস তার কর্মে বার বার প্রতিফলিত হয়েছে। দেশের সংগীতাঙ্গনে তিনি চির অক্ষয় হয়ে থাকবেন।

নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে এ দেশের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন বুলবুল। তার শূন্যতা অনেক দিন পরেও পূরণ হবে না।

এন্ড্রু কিশোর বলেন, আমরা যারা এখনো বেঁচে আছি, যারা ভবিষ্যতে আসবেন; তাদের সবার দায়িত্ব হলো আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সৃষ্টিকর্মকে বাঁচিয়ে রাখা।

বেলা ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধা শেষে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। সেখানে বাদ জোহর তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর এফডিসি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জানাজা। তাতে অংশ নেন চিত্রনায়ক আলমগীর, রিয়াজ, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান প্রমুখ। এরপর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে সমাহিত করা হয়।

উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার ভোরে আফতাবনগরের নিজ বাসায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।

সর্বশেষ খবর