শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

নকল বয়সের আসল সনদ

মির্জা মেহেদী তমাল

নকল বয়সের আসল সনদ

সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আশুরা আক্তার চাঁদনী। স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিল। পথে তাকে অপহরণ করা হয়। রূপনগর থানায় এ বিষয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা হয়। বাদী চাঁদনীর দাদা জহুর মাতব্বর। এ ঘটনায় পুলিশ অন্যতম আসামি দেলোয়ারকে গ্রেফতার করে। কিন্তু কিছুদিন পরই দেলোয়ার জামিনে মুক্তি পেয়ে যান। এতে হতবাক চাঁদনীর পরিবার। কীভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেলোয়ারের জামিন হয়ে গেল, এমন প্রশ্ন এখন পরিবারের মধ্যে। এ বিষয়ে আদালতে আবেদন জানান চাঁদনীর দাদা। আদালতের নির্দেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এ মামলার তদন্ত শুরু করে। পিবিআইর ঢাকা মহানগর অঞ্চল সূত্র জানান, আদালতের নির্দেশে এ মামলা তদন্ত করে পিবিআই। তদন্তে কিশোরী চাঁদনীর বয়স নিয়ে জালিয়াতির প্রমাণ মেলে। এ-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়। চাঁদনীর ভুল তথ্যসংবলিত জন্মসনদ আদালতে উপস্থাপন করে এই আসামি জামিন নিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আর এই ভুয়া জন্মসনদ তৈরি করে দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই। তদন্তসূত্র জানান, চাঁদনীর বাবার মৃত্যুর পর তার মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দাদা জহুর মাতব্বরের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করে চাঁদনী। ২০১৭ সালের ৩ আগস্ট সকালে তাকে অপহরণ করা হয়। এ ঘটনায় রাজধানীর রূপনগর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন জহুর। তার অভিযোগ অনুযায়ী, অপহরণে দেলোয়ার ছাড়াও জড়িত ছিলেন শামীম হোসেন, আনোয়ার হোসেন, নাসরিন আক্তার ও রেজিয়া বেগম। মামলায় দেলোয়ার হোসেন জামিন পাওয়ার পর জহুর মাতব্বর জানতে পারেন, চাঁদনীকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখাতে আদালতে একটি জন্মসনদ দাখিল করা হয়েছে। পাশাপাশি শামীম হোসেনের সঙ্গে চাঁদনীর বিয়ে নিবন্ধনের কাগজও জমা দেওয়া হয়েছে। আদালতে জমা দেওয়া জন্মসনদ অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ১৯৯৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ ঘটনার সময় তার বয়স ১৯ বছর। এভাবে আদালতের সামনে উপস্থাপন করা হয় যে অপহরণ নয়, প্রাপ্তবয়স্ক চাঁদনী স্বেচ্ছায় চলে গিয়ে বিয়ে করেছেন। মামলার বাদী জহুরের দাবি, এ জন্মসনদ ভুয়া। সংগত কারণে শিশু চাঁদনীর বিয়েও আইনসিদ্ধ নয়। তদন্তকারী পিবিআইর কর্মকর্তারা বলেন, চাঁদনীর প্রকৃত জন্মসনদ অনুযায়ী তার জন্ম ২০০৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ ঘটনার সময় তার বয়স ছিল সাড়ে ১১ বছর। ২০১৫ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার সনদেও তার একই জন্ম তারিখের উল্লেখ রয়েছে। তার স্কুলের প্রধান শিক্ষকও কাগজপত্র ঘেঁটে তদন্ত কর্মকর্তাকে একই তথ্য দিয়েছেন। তবে ১৯ বছর বয়স দেখানো অন্য জন্মসনদটিও যাচাইয়ের সময় সঠিক বলে মত দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

 তারা জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই ওই জন্মসনদ দেওয়া হয়েছে। আবেদন ফরমে স্থানীয় নারী কাউন্সিলর ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসারের স্বাক্ষর রয়েছে। তবে সিটি করপোরেশন অফিস থেকে কে এই জন্মসনদ তুলেছেন, সে সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্যই সংরক্ষণ করেননি। এ ছাড়া আবেদন ফরমে চাঁদনীর নাম লেখা থাকলেও সেটির হাতের লেখা তার নয় বলে পিবিআইর তদন্তে উঠে এসেছে।

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, যাচাইয়ে দেখা গেছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষ জন্মসনদ দিলেও চাঁদনীর সঠিক বয়স যাচাই করেননি। অর্থাৎ ভুল তথ্যের সনদটি কার্যত সঠিক নয়। তদন্তে এও স্পষ্ট যে, এভাবে যাচাই ছাড়াই জন্মসনদ দেওয়া হচ্ছে। এসব সনদ ব্যবহারে অনেক ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভুয়া জন্মসনদে ভয়ঙ্কর অপরাধীরাও জামিনে ছাড়া পেয়ে লাপাত্তা বনে যাচ্ছেন। তাদের আর খোঁজখবরও পাওয়া যাচ্ছে না। যাচাই-বাছাই ছাড়া ভুয়া জন্মসনদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসগুলো থেকেই। অপরাধীরা যেভাবে পার পাচ্ছেন ভুয়া জন্মসনদ দেখিয়ে, তেমনি ভিনদেশিরাও একই কায়দায় জন্মসনদ তৈরি করে নিচ্ছেন। মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা এমন জন্মসনদ নিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করছেন। বিদেশে গিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। কিন্তু দায় নিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর