সোমবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
কৃষি

বাহারি শালবন

মোস্তফা কাজল, গাজীপুর থেকে ফিরে

বাহারি শালবন

বাহারি শালবন ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের প্রধান আর্কষণ। বাংলাদেশের মোট ১৭টি জাতীয় উদ্যানের অন্যতম ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানটি। ১৯৭৪ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু হলেও একে জাতীয় উদ্যান হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় ১৯৮২ সালের ১১ মে। অনিন্দ্য সুন্দর এই উদ্যানটি মূলত গ্রীষ্মম লীয় আর্দ্র পত্র পতনশীল বন। শাল বা গজারি এই উদ্যানের প্রধান বৃক্ষ। শালবনের বৈচিত্র্যময় রূপমাধুরী আর জঙ্গলের অপরূপ দৃশ্য অনুভবের জন্য প্রত্যেক বছর এখানে আসেন কয়েক লাখ পর্যটক। সৌন্দর্য, স্বতন্ত্র  বৈশিষ্ট্য আর বৈচিত্র্যময়তার জন্য অনন্য এ উদ্যানের জুরি নেই। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন লাখ পর্যটক আসেন উদ্যানটিতে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি উদ্যানের ভিতরে গড়ে  তোলা হয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা, সুউচ্চ পরিদর্শন টাওয়ার, প্রজাপতি বাগান, কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্র, শিশুপার্কসহ নানা কৃত্রিম স্থাপনা। তবে সৌন্দর্যের সঙ্গে কদর্য দিকগুলোও ভুলে যাওয়ার নয়। নানা অপরাধমূলক কর্মকা  থেকে নিরাপদ থাকতে গহিন জঙ্গলে যাওয়া নিরুৎসাহিত করে থাকে স্বয়ং উদ্যান কর্তৃপক্ষই। ছুটি কিংবা শহুরে কর্মব্যস্ততার যান্ত্রিক জীবনের মধ্যে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে কাটাতে পারেন দু’দ  প্রশান্তিময় সময়। হারিয়ে যেতে পারেন পাখিদের মনোলোভা সুরে, কিংবা হৃদয়-কাড়া শালবনের মোহনীয় রূপের মূর্ছনায়। দৃষ্টি আর্কষণ করা হলে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা শফিকুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভাওয়াল বনের পর্যটক আকর্ষণে কাজ করে যাচ্ছে বন বিভাগ। এই উদ্যানের প্রধান বৃক্ষ শাল। এছাড়াও এ বনে শনাক্ত করা হয়েছে ৫২টি পরিবার ও ১৪৭টি গোত্রের ৩৫৬ প্রজাতির উদ্ভিদ।

এর মধ্যে জিগা, অর্জুন, আলই, মেহগনি,আকাশমনি,কড়ই,কাঁঠাল,আমলকী,হরতকি,বহেরা ইত্যাদি বেশি পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে শালগাছগুলো রোপণ করা হয়নি। প্রাকৃতিকভাবে পূর্বের গাছগুলোর গোড়া থেকে এগুলোর জন্ম হয়েছে। বর্তমানে নতুন করে শালগাছ  রোপণ না করার নেপথ্যে রয়েছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি। শাল বা গজারিকে তারা কম উৎপাদনশীল বিবেচনা করে এখানে ইউক্যালিপটাস ধরনের দ্রুত বর্ধনশীল বৃক্ষ রোপণে অর্থায়ন করে আসছে। বনের বুক চিড়ে রয়েছে ফসলের খেত। কালের বিবর্তনে নানারকম প্রতিকূলতা আর অযত্ন-অবহেলায় জাতীয় উদ্যানের বৈচিত্র্য, রং-রূপ ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। তবে বনবিভাগ হারানো ঐতিহ্য ফিরে আনতে নানাবিধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তথ্য অনুযায়ী, উদ্যানের বেদখল হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধারের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় নানারকম বন্যপ্রাণী অবমুক্ত করা হচ্ছে ও উদ্যানের বিভিন্ন জায়গায় বট, তমাল, আগরসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদ  রোপণ করে বনের পরিবেশ ঠিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তা যে প্রয়োজনীতার তুলনায় নিতান্তই সামান্য তা এই উদ্যান ভ্রমণে গেলেই টের পাওয়া যায়। রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠের জেলা গাজীপুরের সদর ও শ্রীপুর উপজেলা জুড়ে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের অবস্থান। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার। পুরো পরিকল্পনায় গাজীপুর সদর ও শ্রীপুর উপজেলার ৩৫টি মৌজা ও ১৩৬টি গ্রামের ৫০২২ হেক্টর জায়গাজুড়ে জাতীয় উদ্যানের অবস্থান। মূল উদ্যানটি মূলত ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের পাশে ৯৪০ হেক্টর জমির উপর অবস্থিত।

রূপ ও বৈচিত্র্য : ভাওয়াল গড়ের অংশ ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান একটি প্রাকৃতিক বনভূমি। রূপ, বৈচিত্র্য ও বহুমাত্রিক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য এই উদ্যানটি অনন্য। পাতা ঝরা বৃক্ষের এই বন সময়ে সময়ে পাল্টায়  তার রূপের বাহার। শালবৃক্ষের মায়ায় ঢাকা এই উদ্যানে গেলেই চোখে পড়বে ঘন বন, ঝোপ-জঙ্গল। শীতকালে যদিও পাতা পড়ে গিয়ে বনের রূপ অনেকটা ম্লান হয়ে পড়ে, অন্যান্য মৌসুমগুলোতে  চোখে পড়বে গাঢ় সবুজের মনলোভা সৌন্দর্য। উদ্যানের ভিতরে হাঁটার জন্য রয়েছে পরিকল্পিত রাস্তা ও হাইকিং ট্রেইল। উদ্যানের বুক চিরে সর্পিল ফসলি জমির অবস্থান। গহিন অরণ্যের মাঝ দিয়ে হেঁটে  হেঁটে উপভোগ করা যায় নির্জনতার স্বাদ। এ উদ্যানের  মোহনীয়তাকে পূর্ণ করেছে কয়েক মাইল বিস্তৃত বিশালাকার কয়েকটি লেক, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পদ্মপুকুর। এই লেকটিতে পদ্মফুলের নয়নাভিরাম  সৌন্দর্য হৃদয়কাড়া। সেই সঙ্গে অরণ্যের গাঢ় সবুজে জলের সমাহার এই উদ্যানের সৌন্দর্যকে করেছে অনন্য। লেকগুলোতে নৌকা ভ্রমণের স্বাদ নেওয়া যায়। আবার ইচ্ছে করলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থাও আছে। যদিও সেজন্য একটি নির্দিষ্ট অংকের অর্থ গুনতে হয়। এখানকার মাটির রং ধূসর। যাকে বলা হয় লালমাটি। শুকনো অবস্থায় এই মাটি ইটের মতো শক্ত হলেও পানির সংস্পর্শে গা এলিয়ে দেয়। মাটির রং ধূসর হওয়ার কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। এই এলাকার মাটিতে অম্লত্বের পরিমাণ অনেক বেশি। প্রায় ৫.৫ পিএইচ। এই বনটি পত্র পতনশীল বন হওয়ার কারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটি ঘটে তা হলো ঝরা পাতাগুলো মাটিতে পড়ে হিউমাস তৈরি করে ও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। ফলে খুব সহজেই এখানে জন্মায় নানাবিধ বৃক্ষ, লতাপাতা।

বন্য প্রাণি : উদ্যানে শনাক্ত করা পাখিগুলোর মধ্যে হিরগল, লালচিল, বক, দোয়েল, হটটিটি, মাছরাঙা, কুরা ঈগল, হাড়ি চাচা, বেনে বৌ, বুলবুল, নীলকণ্ঠ, কাক, শালিক, চড়ুই, পেঁচা, টিয়া, মৌটুসী, পানকৌড়ি,  মোহনচূড়া অন্যতম। নির্জন বনের মধ্যে হাঁটার সময় নানারকম পাখির কিচির-মিচির ডাকে পাওয়া যায় অপার্থিব অনুভূতির স্বাদ। ভাওয়াল বনে একসময় ছিল বাঘ, চিতা, কালোচিতা, হাতি, মেছোবাঘ, ময়ূরসহ নানা বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ। কালের বিবর্তনে এখন এ প্রাণীগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। বিলীন হয়ে  গেছে গহিন বনের অস্তিত্বও। তবে এখনো এই বনে  দেখা মেলে অল্প কিছু হরিণ, বানর, বন্যশূকর, সজারু, বনবিড়াল, কাঠবিড়ালিসহ প্রায় ১৩২ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর। এর মধ্যে ১৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮৪ প্রজাতির পাখি ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর