বুধবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

টিআর কাবিখা দুর্নীতি ও মাঠের নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার

গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়নে বরাদ্দ দেওয়া টিআর ও কাবিখার বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের

নিজস্ব প্রতিবেদক

টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির (কাবিখা) অনিয়ম-দুর্নীতি এবং মাঠ পর্যায়ের নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধে সতর্ক পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এসব বিষয়ে মাঠে নজরদারি থাকছে দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর। জনপ্রতিনিধিরা যাতে কোনোভাবে টিআর ও কাবিখার গম, চাল বিক্রি কিংবা আত্মসাৎ করতে না পারেন সেজন্য সরকার নতুন পদ্ধতিতে যাচ্ছে। নতুন পদ্ধতিটি কী হবে- তা নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়নে বরাদ্দ দেওয়া টিআর ও কাবিখার বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সরকারের এ বরাদ্দ থেকে গ্রামীণ উন্নয়নে কোনো কোনো এলাকায় ৩০ শতাংশ কাজও হতো না। আবার কোনো কোনো এলাকায় কাজের হার ছিল একেবারে শূন্য। এ অনিয়ম দূর ও টিআর, কাবিখার বরাদ্দের ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিতকরণে কাজ করছে সরকার। একইভাবে মাঠ পর্যায়ে বিশেষ করে স্কুল-কলেজে পিয়ন, দফতরি থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিভাগের তৃণমূল পর্যায়ে জনবল নিয়োগে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন তদন্তে অভিযোগের সত্যতা বেরিয়ে এসেছে। এবার সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি শূন্যে নামিয়ে আনা। সেজন্য নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সরকার টিআর ও কাবিখায় অনিয়ম দূর করতে বিভিন্ন সময় নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু কোনোভাবেই এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম দূর করা যায়নি। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়নে এবং প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক সচ্ছলতার জন্য বরাদ্দ দেওয়া টিআর ও কাবিখা প্রকল্প বার বার হোঁচট খেয়েছে। সূত্র জানান, মাঠ পর্যায়ে এসব প্রকল্পে অনিয়মের কারণেই গত সরকারের শেষ দিকে মন্ত্রী ও এমপিদের চাপ থাকার পরও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কঠোর অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে টিআর ও কাবিখায় বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।

খাদ্য এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানান, প্রতি বছর টিআর ও কাবিখার বিপরীতে সরকার বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ দিত গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য। কিন্তু ভুয়া প্রকল্প বানিয়ে এসব বরাদ্দ আত্মসাৎ করে ফেলতেন মন্ত্রী ও এমপিদের আশীর্বাদপুষ্ট স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। তাদের কাছে বিষয়টি এমন যে, এই বরাদ্দ দেওয়া হয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জন্য। সূত্র জানান, শেখ হাসিনার নতুন সরকার দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে অনেক বিষয়ে বেশকিছু পরিবর্তন আনছে। টিআর ও কাবিখা প্রকল্প বাস্তবায়নেও পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে আগামীতে টিআর ও কাবিখা বাস্তবায়নের জন্য মাঠ প্রশাসনকে কাজে লাগানোর কথা ভাবছে সরকার। স্থানীয় এমপিরা এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়কে পত্র দেবেন। তার আলোকে মন্ত্রণালয় টিআর ও কাবিখার জন্য বরাদ্দ দেবে জেলা প্রশাসনের অনুকূলে। জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানেই প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। টিআর ও কাবিখার অনিয়ম-দুর্নীতি কীভাবে দূর করা যায়- জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) চ্যাপ্টারের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘টিআর ও কাবিখা মূলত দেশের প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুবিধার্থে সরকারের একটি উদ্যোগ, একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকার। তবে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কিছু নয়।’ তিনি বলেন, ‘এর অন্যতম কারণ হচ্ছে যারা এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তারা প্রভাবশালী। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর। তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কখনই তাদের শাস্তি দেওয়া হয়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের শাস্তি না দেওয়া যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ অনিয়ম বন্ধ হবে না।’ ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সরকারকে এদের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই সমস্যা কিছুটা কমে আসবে। তার মতে, টিআর-কাবিখার অনিয়মে যারা জড়িত তারা রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে নিজেদের সম্পদ বিকাশের চেষ্টা করেন। তাদের এ অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলেই টিআর-কাবিখার বিষয়ে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হবে। শুধু টিআর ও কাবিখাই নয়, এবার সরকার মাঠ পর্যায়ে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ডিসি, ইউএনও অফিস, জেলা সিভিল সার্জন অফিসসহ বিভিন্ন অফিস ও দফতরে এমএলএসএস, গাড়িচালকসহ চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে আর্থিক অনিয়ম বন্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের এসব নিয়োগে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ স্বতঃসিদ্ধ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব অভিযোগ প্রমাণিতও হয়েছে। তাই সরকার এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়মকে ছাড় দেবে না। এসব ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও দুদক বিশেষ নজর দেবে। অবশ্য নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কমিটমেন্ট যদি জোরালো হয় এবং এর বিরুদ্ধে কার্যক্রম নেওয়া হয় তাহলে দুর্নীতি থাকবে না।’ তিনি বলেন, ‘এসব দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ধরে দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলে অন্যরা আর দুর্নীতি করার সাহস করবে না। যারা দুর্নীতিগ্রস্ত তাদের মধ্যে ভয় ঢুকবে, আতঙ্ক আসবে। তাহলেই দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে ছোট পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে নীতিমালা আছে তাতে কোনো গলদ নেই। গলদ হচ্ছে মানুষের মধ্যে। তাই যারা অনিয়ম করবে তাদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর