শনিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

আঁকে আঁকে জীবনের বাঁক

মাহবুব মমতাজী

আঁকে আঁকে জীবনের বাঁক

পঞ্চাশ বছর ধরে রং-তুলির আঁকে জীবন ফুটিয়ে তুলেছেন ৬৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ হানিফ পাপ্পু। ছবির পর ছবি আঁকছেন। আঁকে আঁকে পার হয়ে এসেছেন নিজের জীবনের বাঁকের পর বাঁক। শুধু পাপ্পু নন, তার মতো দেশময় কোনো মতে টিকে থাকা যত শিল্পী সবারই সমান দশা। জীবনে এরা স্বপ্ন দেখতেন একদিন হবেন নামজাদা। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। একটা সময় আঁকাআঁকির বেশ দাপট ছিল। ছবি আঁকাই প্রধান পেশা ছিল কারও কারও। এদের মধ্যে হানিফ পাপ্পু নিষ্ঠাবান অঙ্কনশিল্পী। অনেকের কাছে তিনি রিকশা পাপ্পু নামে পরিচিত। পাপ্পু বলেন, হাতে আঁকার যুগ শেষ। আগে সিনেমা হলে ছায়াছবি মুক্তি পাওয়া মানে হলটির দেয়ালে বিশাল ব্যানার। ব্যানারে রং-তুলিতে আঁকা কলাকুশলীদের মুখ। নায়িকার কষ্ট, নায়কের বীরত্ব আর পার্শ্ব চরিত্রগুলোর নানা অভিব্যক্তি। নতুন ছবি মুক্তি পেলেই হাতে আঁকা ব্যানার-পোস্টার দেখা যেত শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। কোনো শিল্পী নিপুণভাবে এঁকে দিতেন নায়ক-নায়িকাদের আবেগঘন মুখ, চোখ ও বিভিন্ন দৃশ্যপট। এখন আর নেই সেই সোনালি দিন। নানা ধরনের অভাব পাপ্পুদের পিছু না ছাড়লেও রং-তুলিকে তারা ছেড়ে দিতে পারেননি। তবে ফুরিয়ে যাচ্ছে রঙের সেই মানুষগুলোর দিন।  পাপ্পু এখন তার নিজ এলাকা পুরান ঢাকার চকবাজারে হোসেনি দালান রোডে আঁকাআঁকির ছোট ছোট কাজ করে দিনাতিপাত করছেন। কয়েকদিন আগে তার ছোট্ট দোকানে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। প্রায় ৪/৭ বর্গফুটের দোকানটিকে রাঙিয়েছেন নানা ধরনের ক্যানভাসে। তিনি জানান, সন্তানের মধ্যে তার একটি মাত্র মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। রং-তুলির কাজ শেখার পর ঢাকাতেই সিনেমা হলের বড় পোস্টার ও রিকশার পেছনে আঁকাআঁকির কাজ শুরু করেন। ঘুরেছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কাজের চাপে দম ফেলবার সময় পাননি। যেখানেই বড় বড় অনুষ্ঠান সেখানেই রং-তুলি নিয়ে ছুটে যেতেন পাপ্পু। অনেকে উৎসাহ নিয়ে নিজের প্রতিকৃতি আঁকানোর জন্য আসতেন তার কাছে। এভাবেই ছবি আঁকার নেশা ধরে গেল। নিজের সংসার ও মেয়ের লেখাপড়া সব কিছু চলত আঁকাআঁকির আয় দিয়ে। কিন্তু এখন এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সবাই। হাতে কাজ নেই, আগে অনেক শিষ্য ছিল। এখন তারাও হতাশ। নেমে পড়ছে বিভিন্ন পেশায়। পাপ্পু বলেন, রিকশার পেছনে সিনেমার ছবি আঁকা এক সময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। তখন সারা ঢাকায় রিকশার পেছনে ছবি আঁকতেন মাত্র তিনজন। পাপ্পু, নারিন্দার রফিক আর শিয়াগলির আহমদ। অনেক বিখ্যাত ও ব্যবসাসফল ছবির ব্যানার এঁকেছেন তিনি। এখন অঙ্কনশিল্পীদের কেউ তেমন গুরুত্ব দেন না। অর্ডারগুলো রাঘব বোয়ালরা নিয়ে যায়। আর পাপ্পুদের চলতে হয় টানাটানির মধ্যে। তিনি এখনো আঁকেন। তবে আর আগের মতো ছায়াছবির পোস্টার নয়। জানা গেল, রং-তুলি ছবির সঙ্গেই মিলেমিশে বেড়ে উঠেছেন পাপ্পু। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিও এই ছবি আঁকার গল্প ঘিরে। পাঁচ বছর বয়স থেকেই এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে যান তিনি। তার মামা ছবি আঁকতেন। ওখানেই হাতেখড়ি হয় তার। দিনে হাতযশ হয়েছে। এমন সময়ও গেছে যে, পাঁচ দিনে ৫০টার মতো পোস্টার-ব্যানার আঁকতেন। তার মূল ওস্তাদ ছিলেন গিরিন বাবু। গিরিন এখন ভারতে থাকেন। আঁকাআঁকির দিন বদলে গেছে। হাতে আঁকা হয় না এখন পোস্টার আর ব্যানার। ডিজিটাল পোস্টার আর প্রিন্টিং পোস্টারের ভিড়ে হারিয়ে গেছে হাতে আঁকা পোস্টারের কদর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর