শিরোনাম
রবিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
নদী বাঁচাও ১

দখলে দূষণে করতোয়া এখন নালা

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

দখলে দূষণে করতোয়া এখন নালা

বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র হয়ে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা করতোয়া আর নদী নেই। দূর বা কাছ থেকে দেখলে শহুরে নর্দমা ছাড়া কোনোভাবেই আর বোঝার উপায় নেই যে এটি নদী। দখলে দূষণে করতোয়া এখন শহুরে নালা। দখলের সঙ্গে শহুরে বর্জ্য ফেলায় নর্দমায় পরিণত হয়েছে ইতিহাসখ্যাত করতোয়া। ইচ্ছামতো দখল আর দূষণে মরে গেছে নদী। ঢেউ নেই, পানি নেই, পাড় নেই। এসবের বদলে আছে নদীর পাড়ে সুউচ্চ ভবন, অবৈধ দখলদার, বাড়িঘর, অবৈধ স্থাপনা, নদীর বুকে ময়লা আর শহরের বর্জ্য নদীতে ফেলার সহস্র ড্রেনেজ ব্যবস্থা। নদী বাঁচাতে জেলা প্রশাসন থেকে ৩১ জন দখলদারের তালিকা করলেও কোনো কাজের কাজ হয়নি। উচ্ছেদ অভিযান না থাকায় দখলদাররা হয়েছে আরও উৎসাহিত।

জানা যায়, প্রায় ২০০ কিলোমিটার করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষে প্রাচীন পুন্ড্রনগরীর গোড়াপত্তন হয়। সেই সভ্যতার সঙ্গে এখন করতোয়া নদীও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে চলেছে। উত্তরবঙ্গের নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার নিচু জলাভূমি থেকে উৎপত্তি হয়েছে করতোয়া নদী। দিনাজপুরের পার্বতীপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে রংপুরের বদরগঞ্জ, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ হয়ে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় প্রবেশ করেছে এ নদী। করতোয়া বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহিত হয়ে জেলার শেরপুর উপজেলার চান্দাইকোনায় বাঙালি নদীতে গিয়ে মিলেছে। উৎপত্তিস্থল থেকে এর দৈর্ঘ্য ২০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে দখল আর ভরাটের কারণে এটি এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৮৮ সালে বন্যার সময় তৎকালীন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদরের খুলশিচাঁদপুর এলাকায় বাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণের মাধ্যমে করতোয়া নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। সে সময় ওই অংশে করতোয়ার মূল স্রোত একটি শাখা নদীর মাধ্যমে বাঙালি নদীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এতে গোবিন্দগঞ্জ থেকে ভাটির দিকে, অর্থাৎ বগুড়ার দিকে করতোয়া নদীর প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে দিনে দিনে সরু খালে পরিণত হয়। একদিকে পানিশূন্যতায় প্রবাহ বন্ধ, অন্যদিকে ভরাট আর দখলের ফলে নদীটি এখন মৃত। করতোয়া নদীটি শহরের ভিতরের অংশে যে যেখানে পেরেছে দখল ও ভবন নির্মাণ করেছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনেই দখল করে নদীর ভিতর বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। চলছে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ। এই স্থানে নদীর ভিতরের অংশ ঘিরে নিয়ে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে, ‘পৈতৃক সূত্রে এই জায়গার মালিক খাজা একরামুল হক এবং ডা. খাজা এ জি এম হক। জমির পরিমাণ ২৮ শতাংশ।’ অথচ ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল, ১৯৯০-এর ৩৩৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, তীরবর্তী কোনো জমির মালিক নদীর তলদেশ বা ফোরশোর দখল করতে পারেন না। ৩৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নদীর দুই ধারে যে অংশে শুষ্ক মৌসুমে চর পড়ে কিন্তু বর্ষা মৌসুমে ডুবে যায়, তা ফোরশোর হিসেবে বিবেচিত হয়। এদিকে শুষ্ক মৌসুম আসার আগেই করতোয়া নদী পানিশূন্য দেখা যাচ্ছে। দু-একটি স্থানে পানি দেখা গেলেও শহরের ২০ কিলোমিটারে রয়েছে শুধুই ড্রেনের কালো পানি।

দখল করা নদীর তীরে নির্মাণ করা হয়েছে শত শত বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিশাল বিশাল ভবন। সময়-সুযোগমতো প্রভাবশালীরা নামে-বেনামে নদীর তীর দখল করে নিচ্ছে। বগুড়া শহরের এসপি ব্রিজ লেন, ভাটকান্দি, চেলোপাড়া ও ব্রিজ এলাকা, ফুলবাড়ী, মালতীনগরসহ বেশ কিছু এলাকায় নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ভবন। ভবনগুলোর ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হয়েছে নদীর বুকে। এ ছাড়া বগুড়া পৌরসভার প্রধান ড্রেনগুলো মিলিত হয়েছে করতোয়া নদীতে। শহরের আবর্জনা ও বিভিন্ন ক্লিনিক বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে নদীতে। নদীর তলানিতে রয়েছে শহুরে ড্রেনের কালো পানি। শহরতলির বাইরে ইচ্ছামতো বালু উত্তোলন চলছে।

বগুড়া জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখা সূত্র জানায়, শহরের মধ্যে করতোয়া নদীর কয়েকটি স্থান দখল হয়েছে। নদী দখল হয়ে যাওয়া স্থানে বাড়িঘর, ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দখল করা জমির পরিমাণ সাড়ে পাঁচ একর। নদী দখলের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে সর্বশেষ ৩১ দখলদারের নামের তালিকা তৈরি করা হয়। জেলা প্রশাসনের জরিপ দল ৩১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দাখিল করে। দখলদারদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস)। তারা প্রায় পাঁচ একর জমি দখল করে রেখেছে। জেলা শহরের সূত্রাপুর এলাকার ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ প্রায় দেড় শতক জমি দখল করে সীমানাপ্রাচীর দিয়েছেন। ফুলবাড়ীর খয়রুজ্জমান ৯৬ বর্গফুট, রাজাবাজারের আবদুস সোবাহান ৫৪৬ বর্গফুট, শংকর বাবু ও কানাই লাল মিলে ৭১ বর্গফুট দখল করে চালাঘর ও পাকা ভবন নির্মাণ করেছেন। একইভাবে ফতেহ আলী আল আরাবিয়াতুন খালাফিয়া ওয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদের জনৈক মোবারক ২০৯ বর্গফুট, নবাববাড়ী সড়কের এ কে এম ফজলুর রহমান ৮০ বর্গফুট, মোক্তার হোসেন ২৪ বর্গফুট, জোবাইদুল ইসলাম ৫০০ বর্গফুট, মতিয়ার রহমান ৯০০ বর্গফুট, মাজেদ হোসেন ১৮০ বর্গফুট, ডায়াবেটিক হাসপাতাল ৩৫০০ বর্গফুট, গোপীনাথ মন্দিরের সভাপতি আনন্দ ৪০৯ বর্গফুট, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টিএমএসএস নবাববাড়ী পয়েন্টে ৩৭৮ বর্গফুট, সঞ্জীব কুমার বিহানী ২৪০ বর্গফুট, প্রদীপ কুমার রায় ৫৪৪ বর্গফুট, আবদুল জলিল ১৫০ বর্গফুট জায়গা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। সব মিলিয়ে দখলকৃত জমির পরিমাণ সাড়ে পাঁচ একর। টাকার অঙ্কে যার দাম শত কোটি টাকার ওপরে। বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আলিমুল রাজীব জানান, ৩১ জন দখলদারের তালিকা তৈরির পর উচ্ছেদ নথি নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। এরপর টিম গঠন করে পর্যায়ক্রমে অভিযান চালানো হবে। বগুড়া শহরের ভাটকান্দি গ্রামের বাসিন্দা আবদুল আজিজ ঠা ু জানান, স্কুলবয়সে তিনি নদীটি আরও বড় দেখেছেন। তখন নৌকায় পার হতে হতো। এখন নৌকা নেই। সবখানেই ব্রিজ হয়েছে। পানি নেই। ময়লা জমে আছে। শহরের বেশির ভাগ ড্রেনের সংযোগ নদীতে দেওয়া হয়েছে। নদীর পাড়ে বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এতে নদী সরু হয়ে খালে পরিণত হয়েছে। এখন আর আগের মতো সেই নদী মনে হয় না। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, আইন অনুযায়ী কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভেঙে গেলে তা নদীর অংশ। ওই জায়গা কেউ ব্যক্তিমালিকানা দাবি করে ভরাট করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

সর্বশেষ খবর