সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
নদী বাঁচাও ১৬

শুধু নামেই আছে রংপুরের ২৮ নদী

নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর

শুধু নামেই আছে রংপুরের ২৮ নদী

উজানে বাঁধ দিয়ে পানির স্রোতধারা বন্ধ করে দেওয়ার ফলে পানির প্রবাহ না থাকায় দখলদারদের দৌরাত্ম্যে অস্তিত্ব হারিয়েছে তিস্তা বাঁধে রংপুরের প্রায় ২৮টি নদী। এসব নদী এখন  অনেক শীর্ণকায়। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অধীনে নদীগুলোকে শতভাগ পূর্বের অবস্থায় ফেরানো না গেলেও যে অবস্থা আছে তা অবিকৃত রাখা সম্ভব। এমনকি অনেক দখল উচ্ছেদ করে নদীর প্রাণপ্রবাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এতে নদীগুলো বিলুপ্ত নদীতে  পরিণত হবে না। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, রংপুর জেলায় ২৮টি নদীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। নদীগুলো হচ্ছে তিস্তা, তিস্তা (নতুন), ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, চিকলি, শাখা চিকলি, বুল্লাই, টেপরীর বিল, মরা, নলেয়া, মানাস, ধুম, খটখটিয়া, বাইশা ডারা, আলাইকুড়ি, বুড়াইল, বুড়াইল (মীরবাগ), ইছামতি, শ্যামাসুন্দরী, খোকসা ঘাঘট, আখিরা, ভেলুয়া, কাঠগিরি, নেংটি ছেঁড়া, করতোয়া, সোনামতি, নলসিসা এবং মাশানকুড়া। নদী বিশেষজ্ঞ রিভারাইন পিপলের পরিচালক রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান, রংপুরের ২৮টি নদীর অস্তিত্ব বিদ্যমান। কিন্তু এতগুলো নদী থাকলেও এদের কোনো স্বীকৃতি নেই। এ নদীগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবেই এ অঞ্চলের জনজীবনের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। রংপুর শহরের চারদিকে জালের মতো ছড়িয়ে আছে এসব নদী। এ নদীগুলোর পানি গিয়ে পড়েছে ব্রহ্মপুত্র-যমুনায়। অনুসন্ধান বলছে, তিস্তা নদী ভারতের সিকিম থেকে প্রবাহিত হয়ে রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলা হয়ে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে মিশেছে। রংপুর থেকে সৈয়দপুরে মহাসড়ক ধরে যাওয়ার পথে প্রথমেই পাওয়া যায় ঘাঘট নদ। ঘাঘট নদ এসেছে নীলফামারীর তিস্তা থেকে। এই নদ নীলফামারী থেকে তিস্তার পানি নিয়ে চলে যেত ব্রহ্মপুত্রে। এখন তিস্তার মুখ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে তিস্তার পানি বহন করতে পারে না। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে নদীর দুই ধারের সব অঞ্চলের পানি এ নদী বহন করে ভাটিতে ব্রহ্মপুত্রে নিয়ে যায়। যতই বৃষ্টি হোক না কেন, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় না। এ নদীর তীরেই রংপুর জেলা শহর এবং গাইবান্ধা জেলা শহর। ২০০ বছর আগে এ নদীতে জাহাজ চলত। আর এখন নৌকাও ঠিক মতো চলে না। শুষ্ক মৌসুমে নদীটি মৃত নদীতে পরিণত হয়। পরিচর্যা পেলে এ নদীটি বারোমাসি নদীতে পরিণত হতে পারে। আলাইকুড়ি নদীটি মাহিগঞ্জ থেকে প্রবাহিত হয়ে পীরগাছায় ঘাঘটে মিলিত হয়েছে। এখন নদীটি অনেক স্থানে শীর্ণকায়। কোথাও কোথাও সমতলে পরিণত হয়েছে। মানাস নদীর তীরে এক সময় হারাগাছ বন্দর গড়ে উঠেছিল। এ নদীতে জাহাজ চলত। শুধু তাই নয়, হারাগাছ বন্দরে ব্রিটিশরা জাহাজে করে আসত। তারাই প্রথম তামাকের চাষ শুরু করে হারাগাছ এলাকায়। এ নদীটি এখনো রংপুর অঞ্চলের কল্যাণকামী একটি নদী। রংপুর শহরের অদূরে উত্তর দিক ঘেঁষে প্রবাহিত বুড়াইল নামে দুটি আলাদা নদী আছে। এ নদীর সঙ্গে শহরের কেডি খাল। আর একটি বুড়াইল নদী আছে কুড়িগ্রাম-রংপুর মহাসড়কের নব্দীগঞ্জ-মীরবাগ নামক স্থানের মাঝামাঝি। নদী দুটি বর্ষার পানি বয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার কারণে ফসলের ক্ষতি সহজে হয় না। এদিকে, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ থেকে একটি নদী রংপুর-সৈয়দপুর মহাসড়কের ঘাঘট নদের সাত আট কিলোমিটার পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি বদরগঞ্জ এলাকায় খাঁড়ুভাঁজ নাম নিয়েছে। কয়েকটি নদীর পানি নিয়ে ভাটির দিকে মধ্যম আকৃতির যমুনেশ্বরী নদীটি মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত। বুল্লাই নদী পার হয়ে এ নদীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ নদী থেকে সৈয়দপুর যেতে সরু আরেকটি নদীর অস্তিত্ব আছে। যার নাম নেংটি ছেঁড়া। রংপুরের আদি শহর মাহিগঞ্জ গড়ে উঠেছিল ইছামতি নদীর পাড়ে। নদীটি সর্বশেষ অস্তিত্ব নিয়ে কোনোরকম টিকে আছে। রংপুর জেলার ওপর দিয়ে কোনোমতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে সোনামতি, মরা, আখিরা, কাঠগরি, ভেলুয়া, নলসিসা, নলেয়া, খটখটিয়া, টেপরির বিল, শাখা চিকলিসহ কয়েকটি নদী। ‘নতুন তিস্তা’ নদীটি ২০১৮ সালে নতুন করে তৈরি হয়েছে। গঙ্গাচড়ার মহিপুর সেতুর চার-পাঁচ কিলোমিটার উজানে বাঁধ ভেঙে নতুন প্রায় ১৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে আবারও তিস্তায় মিলিত হয়েছে। এই নতুন তিস্তা পুরাতন তিস্তার আন্তঃশাখা নদী। এসব নদী এখন নামেই টিকে আছে। আবার যেগুলোতে সামান্য পানি প্রবাহমান আছে সেগুলোকে কোথাও কোথাও ব্যক্তিমালিকানায় নিয়ে আবাদ করা হচ্ছে। কোথাও প্রভাবশালীরা বালু তুলে বিক্রি করছে, স্থাপনা  তৈরি করেছে। ফলে নদীগুলোর অধিকাংশই বিলুপ্তির পথে। নদী বিশেষজ্ঞ ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান, নদ-নদীগুলো এ অঞ্চলের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, ভূমির গঠন সব কিছুর ওপর প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। মানুষের সংস্কৃতি-অর্থনীতিতেও এগুলোর প্রভাব অনস্বীকার্য। কালের বিবর্তনে নদীগুলোর অবস্থা করুণ হয়েছে। রংপুর জেলায় যে ২৮টি নদী আছে তা অনেকের জানারও বাইরে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। তিনি জানান, জেলা এবং উপজেলা নদী রক্ষা কমিটি বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকারি নদীর তালিকাভুক্ত করতে পারে। সরকারি তালিকাভুক্তিতে এ নদীগুলোর নাম থাকলে নদীগুলো রাষ্ট্রীয় পরিচর্যা পাবে। ৪০ ও ৬২ সালের রেকর্ড দেখে যেখান থেকে নদী আছে সেখান থেকে উদ্ধার করতে হবে। অন্যথায় এ সংখ্যা ইতিহাসে থাকবে। ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান, হাই কোর্ট নদী রক্ষায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে অভিভাবক ঘোষণা করেছে। এখন এ নদীগুলোর প্রকৃত যত্ন করার প্রধান দায়িত্ব জাতীয় নদী রক্ষা কমিটির। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন চাইলে নদীর প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশের নদ-নদীর সংখ্যা উল্লেখ করতে পারবে।

 

সর্বশেষ খবর