শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

অরক্ষিত শাহজালাল বিমানবন্দর

সীমানা দেয়াল ভেঙে ৭টি গোপন রাস্তা ও সুড়ঙ্গ, নিরাপত্তা চৌকিতে বখাটেদের আড্ডা

সাঈদুর রহমান রিমন

অরক্ষিত শাহজালাল বিমানবন্দর

হযরত শাহ জালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আবার অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বিমানবন্দরের সামনে প্রবেশ অংশে বিভিন্ন সংস্থার ব্যাপক তৎপরতায় আপাত ‘কঠোর নিরাপদ স্থান’ মনে হলেও সিংহভাগ অংশই নিয়ন্ত্রণহীন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দুবাইগামী একটি ফ্লাইট ছিনতাইয়ের কবলে পড়ার ঘটনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছে। বিমানবন্দরসহ চারদিকের সীমানা প্রাচীর সরেজমিন ঘুরে এই বেহাল চিত্র লক্ষ্য করা গেছে।

প্রায় ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং চার সহস্রাধিক মিটার প্রশস্ত বিরাট আয়তনের এ বিমানবন্দরের সীমানা প্রাচীর ভেঙে অন্তত ৭টি গোপন রাস্তা বানানো হয়েছে। দেয়াল ভেঙে তৈরি করা হয়েছে আরও ৫-৬টি ফোকলা। সীমানা দেয়ালের নিচ দিয়েও মাটি খুঁড়ে বানানো আরও কয়েকটি গর্ত রয়েছে। তাছাড়া রানওয়ের পানি অপসারণের জন্য নির্মিত কালভার্টের ভিতর দিয়েও অনেককে অনায়াসে রানওয়ে ঘেঁষা স্থান পর্যন্ত আসা-যাওয়া করতে দেখা গেছে। গোপন সুড়ঙ্গপথ দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে একশ্রেণির যুবকদের ভিতরে ঢুকে আড্ডা ও ছাগল-ভেড়া চড়াতে দেখা গেলেও অন্য কোনো সন্দেহভাজন গ্রুপের আসা-যাওয়া আছে কিনা তা বলা মুশকিল। সীমানা দেয়াল ভেঙে অবৈধভাবে গড়ে তোলা প্রবেশপথ ও গর্ত-ফোকলা প্রসঙ্গে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানান, প্রাচীর ভাঙা-মেরামত, কাঁটাতারের বেষ্টনী নির্মাণের যাবতীয় দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশন অথরিটির। বার বার নিরাপত্তা বিঘ্নকারী এসব গুপ্ত প্রবেশপথ ও ফোকলার বিয়য়ে লিখিতভাবে জানানো সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে সে সব দেয়াল মেরামত বা পুনঃনির্মাণ করে না। এমনকি ওই গোপন পথগুলোর আশপাশে নিরাপত্তা বাতিও লাগানো হয় না। ফলে সন্ধ্যার পর থেকেই ঝোপঝাড় বেষ্টিত ওইসব এলাকায় ঘোর আঁধার নেমে আসে। ‘প্রতিটি ফোকলা পয়েন্টে ডিউটি পোস্ট বানিয়ে রাতদিন পাহারায় রাখা সম্ভব নয়’ মন্তব্য করে এপিবিএনের ওই কর্মকর্তা জানান, রাতে সে সব স্থানে পুলিশের ভ্রাম্যমাণ টিম ঘন ঘন টহল দিয়ে থাকে। বিমানবন্দরের প্রবেশপথে যানবাহন থামিয়ে দফায় দফায় তল্লাশি চললেও দালালচক্র, চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রুপ, টেন্ডারবাজ দুর্বৃত্তরা ঢুকে পড়ছে অবাধে। তারা শুধু বিমানবন্দরেই ঢুকে তা নয়, বরং কার্গো হাউসের মতো কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর স্পর্শকাতর স্থানে ঢুকে তারা মালামাল ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটিয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিভিল এভিয়েশন এবং বিমানবন্দর সংলগ্ন অন্যান্য অফিসে যাতায়াত করতে সবাইকে প্রতিদিন এপিবিএনের তল্লাশির মুখে পড়তে হচ্ছে। সিভিল এভিয়েশনের পাস ছাড়া কাউকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কাস্টমস ও কার্গো ভিলেজে যাতায়াত করতেও সাধারণ মানুষসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের হয়রানির শিকার হতে হয়। তবে স্থানীয় পর্যায়ের চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা কোনোরকম পাস ছাড়া কীভাবে এপিবিএনের নিরাপত্তা বেষ্টনী গলিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে, সে প্রশ্নের কোনো জবাব মেলে না। ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারেও নেই কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা। রাজনৈতিক বা ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে যে কেউ ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতে পারেন। কার্গো ভিলেজ এলাকায় চোর আর নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে এখনো ইঁদুর-বিড়ালের খেলা দেখা যায়। সীমানা প্রাচীরের স্থানে স্থানে নির্মিত উঁচু পাকা নিরাপত্তা চৌকিগুলোতে রিকশা-ভ্যানের চালকসহ শ্রমিক শ্রেণির লোকজন বিশ্রাম নেয়, আশপাশের যুবকরা বসায় গল্প-গুজবের আসর। বাউনিয়া মহল্লায় নিরাপত্তা চৌকি ঘেঁষা বাড়ির গৃহবধূ মোমেনা বেগম বলেন, ‘প্রতি রাতেই পুলিশ এসে দুই-এক ঘণ্টা ওই ছোট্ট ক্যাম্পে ডিউটি করেই চলে যায়। তারা কোনো দিনই সারা রাত ডিউটি দেয় না। পুলিশরা যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ বিভিন্ন বাসাবাড়ির দরজা খোলার শব্দ হলেই টর্চলাইট মারে (টর্চ জ্বালিয়ে আলো ফেলে)। মূল প্রাচীরের ভিতরে ঢুকে দ্বিতীয় নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝের ফাঁকা স্থানে ঘুড়ি উড়ায় শিশু-কিশোররা। পাইলট ও ক্রু অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রানওয়ের আশপাশে ঘুড়ি ওড়ানোয় ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনার আশঙ্কা রয়েছে। সীমানা প্রাচীর ঘেঁষা রাস্তা ধরে টহল ডিউটি পর্যবেক্ষণরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সীমানা দেয়ালের চারপাশের রাস্তা খুবই খারাপ এবং ঝোপঝাড়ে ভরা। সেখানে গাড়ি নিয়ে টহল কাজ চালানো সম্ভব হয় না। পায়ে হেঁটে টহল দিতে গেলেও কাদাপানিতে একাকার অবস্থার শিকার হতে হয়। তিনি বলেন, ‘সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে বাইরের অংশে রিং রোড নির্মিত হলে গাড়ি নিয়ে ঘন ঘন পুলিশি টহল দেওয়া সম্ভব হতো। এতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকত আরও সুরক্ষিত। এসব ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলেও সিভিল এভিয়েশন অথরিটির প্রশাসনিক বিভাগের কর্মকর্তারা কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের চারপাশের সীমানা দেয়ালের সঙ্গে ৮টি নিরাপত্তা চৌকি রয়েছে। সে সব চৌকিতে পুলিশ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা সার্বক্ষণিক নজরদারি করে থাকেন। পাশাপাশি সিভিল এভিয়েশন অথরিটির নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীরও নজরদারি ও টহল থাকে। সিভিল এভিয়েশন অথরিটির অপর এক কর্মকর্তা বলেন, চারপাশের উঁচু সীমানা প্রাচীর এবং তার শীর্ষে কাঁটাতারের বেড়াটাই শেষ কথা নয়, ভিতরে বুক সমান উঁচু আরেকটি দেয়ালও নির্মিত আছে। এ কারণে ফাঁক-ফোকর দিয়ে মূল সীমানা প্রাচীরের ভিতরে ঢুকতে পারলেও রানওয়ে পর্যন্ত কেউ পৌঁছতে পারবে না। কিন্তু রানওয়ে এলাকার ইট, পাথর, বালু চুরি করে অনায়াসে আশপাশের এলাকায় কীভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাব সিভিল এভিয়েশন অথরিটির কোনো কর্মকর্তা দেননি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর