মঙ্গলবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

যুগোপযোগী আইন ও প্রয়োগের তাগিদ

আরাফাত মুন্না

যুগোপযোগী আইন ও প্রয়োগের তাগিদ

দেশের আদালতগুলোতে থাকা মামলাজট নিরসনে বহুল ব্যবহৃত বেশ কিছু আইন যুগোপযোগী করার পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগও প্রয়োজন বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। তারা বলেন, বিদ্যমান দেওয়ানি কার্যবিধির বয়স ১০৮ বছর। ফৌজদারি কার্যবিধির বয়স ১১৮ বছর। আর সাক্ষ্য আইনের বয়স ১৪৪ বছর। এসব কার্যবিধি বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেকটাই অকার্যকর। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলেন, বিচারপ্রার্থী মানুষকে দ্রুত প্রতিকার দিতে হলে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি শতাব্দীপ্রাচীন এসব আইনেরও ব্যাপক সংস্কার ও প্রয়োজনীয় নতুন আইন প্রণয়ন জরুরি। জট নিরসনে বর্তমানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণসংখ্যক বিচারক নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি জনবল কাঠামোর সঠিক ব্যবহার করতে হবে বলেও মত তাদের। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলেন, ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন অপরিহার্য। কারণ দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় মামলার ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞের সাক্ষ্য বা অভিমত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো বিশেষজ্ঞ কোনো বিষয়ের ওপর তার অভিমত দিয়ে লিখিত প্রমাণপত্র দেওয়ার দীর্ঘ সময় পর তাকে আবার আদালতে সাক্ষী হিসেবে তলব করা হয়। মধ্যবর্তী এ সময়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মারা যেতে পারেন, অবসরে অথবা বিদেশেও যেতে পারেন। এমন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের সাক্ষ্যের জন্য মামলা-মোকদ্দমা দীর্ঘায়িত হয় বছরের পর বছর। এসব প্রেক্ষাপটে সাক্ষ্য আইনের ৪৫ থেকে ৫১ ধারায় বিশেষজ্ঞের অভিমত, ৫৬ থেকে ৫৮ ধারা এবং ৩০ ও ৯০ ধারা অবিলম্বে সংশোধন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।

আইনজ্ঞরা বলেন, সাক্ষ্য আইনের ৯০ ধারা অনুসারে ৩০ বছরের পুরনো দলিল দিয়ে মামলা-মোকদ্দমা করার সুযোগ রয়েছে। এ কারণে ৩০ বছরের পুরনো জাল দলিল দিয়ে সম্পত্তি দখল করে বৈধ মালিক সেজে অনেকেই অহরহ ভূসম্পত্তি ভোগদখল করছেন। আর প্রকৃত মালিক তার বৈধ স্বত্ব¡ হারিয়ে পথে পথে ঘুরছেন। এ জন্য এই ধারাটিও সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া সাক্ষ্য আইনের ৬০ ধারায় মৌখিক সাক্ষ্য অবশ্যই প্রত্যক্ষ হতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি সংশোধন করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘অপ্রত্যক্ষ’ সাক্ষ্য গ্রহণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এর ফলে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন উপাদান, যেমন মোবাইল, অডিও, ভিডিও, স্থিরচিত্র ইত্যাদিতে দেওয়া বক্তব্য মৌখিক সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা আরও কার্যকর করা প্রয়োজন। বিদ্যমান আইন সংশোধন করে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মামলাজট নিরসনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিচারকাজ বিলম্বিত হলে বিচারপ্রার্থীরা হতাশায় ভোগেন। আবার বিরোধের নিষ্পত্তি দীর্ঘায়িত হলে আরও বিরোধ সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। এ জন্য যেগুলো বাদী-বিবাদীদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে (মীমাংসাযোগ্য) নিষ্পত্তি করা যায়, সেগুলো এডিআরের আওতায় নিষ্পত্তি করতে হবে।’ শফিক আহমেদ বলেন, ‘শত বছরের পুরনো আইন দিয়ে বিচারকাজ পরিচালনা করায় নানা অসুবিধা হচ্ছে। তাই পুরনো আইনগুলো দ্রুত সংশোধন হওয়া জরুরি।’

জানতে চাইলে বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মামলা হওয়ার পর এক পক্ষ এর দ্রুত নিষ্পত্তি চাইলেও অপর পক্ষ চায় তা ঝুলিয়ে রাখতে। এসব কাজে বিচারাঙ্গনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ব্যবহার করে তারা। এটা দুর্নীতি। মামলাজট নিরসন করতে হলে এই দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।’ এ ছাড়া বিদ্যমান জনবল কাঠামোর সঠিক ব্যবহার করেও মামলাজট অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। মামলাজট নিরসনে বিচারকদের ওপর চাপ কমানো প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন হাই কোর্টের সাবেক বিচারপতি ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একজন বিচারকের ওপর যে চাপ থাকে তা বিশ্বের কোথাও নেই। আমাদের হাই কোর্টের বিচারপতিরা প্রতিদিন দেড়শ থেকে দুইশ মামলার শুনানি গ্রহণ করেন। আবার যেসব মামলার রায় দেন, সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিও লিখতে হয়। এটা অস্বাভাবিক।’ তিনি বলেন, নিম্ন আদালতের বিচারকরাও ওভার লোড নিয়ে কাজ করেন। প্রতিদিন তাদেরও শত শত মামলার শুনানি গ্রহণ করতে হয়।’ তাই মামলাজট কমাতে হলে অধিকসংখ্যক বিচারক নিয়োগ দিয়ে বিচারকদের ওপর চাপ কমানো জরুরি বলে মনে করেন তিনি। মামলাজট নিরসনে আইনজীবীদেরও এগিয়ে আসতে হবে উল্লেখ করতে তিনি বলেন, একজন সাধারণ মানুষ আদালতে আসেন আইনজীবীর মাধ্যমেই। কিছু আইনজীবীর হাতেই রয়েছে অধিকাংশ মামলা। তাই তারা কিন্তু নিজেরে ক্লায়েন্ট ধরে রাখতে মামলা ঝুলিয়ে রাখতে চান। মামলা ঝুলিয়ে না রেখে দ্রুত নিষ্পত্তিতে আইনজীবীকেই এগিয়ে আসতে হবে। বিচারক ও আইনজীবীদের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলে মামলাজট নিরসনে সহায়ক হবে বলেও মত সাবেক এই বিচারপতির।

সর্বশেষ খবর