মঙ্গলবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
নদী বাঁচাও ১৭

বড়াল এখন সরু খাল

চাষ করা হচ্ছে ধানসহ বিভিন্ন ফসল

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

বড়াল এখন সরু খাল

গোপালপুরের জবদুল মাঝি। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। এক সময় আসতেন বড়াল নদীতে মাছ ধরতে। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যায় যা মাছ পেতেন, বেচে চলে যেতেন বাড়ি। দিব্যি তার সংসার চলত বড়ালের মাছে। তিনি এখনো আসেন বড়ালের তীরে। তবে মাছ ধরতে নয়, তীরে গড়ে ওঠা দোকানে চা পান করতে। জবদুল মাঝি বলেন, ‘এক সময় এই নদীতে পাল তোলা নৌকা ভিড়ত। পণ্য নিয়ে আসা নৌকাগুলোকে ঘিরে রোজগার হতো মানুষের। মাছ ধরেও চলত অনেকের সংসার। এখন নদীতে ধান চাষ হয়। দুই পাশ দখল দূষণে বড়াল এখন সরু নালায় পরিণত হয়েছে।’ এক সময় রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার পদ্মার শাখা বড়াল নদী ছিল টইটুম্বর। এখানে মাছ ধরে সংসার চালাতেন আশপাশের মানুষ। সেই দিনগুলো ক্ষীণ হয়ে আসে ১৯৮০ সালের দিকে। স্লুইস গেট দেওয়ার পর বড়াল তার খর¯্রােতা রূপ হারায়। আর এখন দখলে বড়াল হয়ে উঠেছে সরু নালা। ২০১০ সালে নদী খননের নামে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নেওয়া ১৩ কোটি টাকার প্রকল্প কোনো কাজে আসেনি। নদী খনন করে সেই বালু নদীতে স্তূপ করে রাখার কারণে বন্যার পানিতে তা আবার নদীতে চলে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে পানি উন্নয়ন বোর্ড ‘বড়াল বেসিন প্রকল্প’ নামে বিভিন্ন অবকাঠামোসহ নদী খনন কাজ শুরু করে। প্রকল্পটির কাজ শেষ হয় ২০০৪-০৫ অর্থবছরে। এই প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন রেগুলেটর, অবকাঠামো, খাল ও নদী পুনঃখননের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৫ দশমিক ২০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করে মূল্য বাবদ ৭৬ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ভূমি মালিকদের পরিশোধ করা হয়। তার পরেও নদী তীরবর্তী এলাকা দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

স্থানীয়রা জানান, বড়াল নদীর আশপাশে যারা বসবাস করছেন, তারা নদী দখল করে সেখানে ধান চাষ করেন। প্রভাবশালীরাও আছেন এই তালিকায়। ফলে মূল পদ্মা থেকে পানি যাতে বড়ালে আসতে না পারে সেজন্য মাটি ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় রায়হান আলী জানান, বড়ালে এখন ধান চাষ হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় দিন দিন বড়াল দখল হয়েই যাচ্ছে। সরু নালার মতো এখন যেটুকু আছে, তা রক্ষার উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তিনি। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, বড়ালে পদ্মার পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখতে এবং নাব্য ফিরিয়ে আনতে বড়াল নদীকে ঘিরে গত ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ‘নাটোরের নারদ ও মুসা খান (আংশিক) নদী ও রাজশাহীর চারঘাটের রেগুলেটরের ইনটেক চ্যানেল খনন’ নামে ১৩ কোটি ৩ লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রায় ১৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার নদী খনন ও প্রবেশ মুখে খনন করতে এই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চারঘাট বড়াল নদীর ইনটেক চ্যানেল খনন কাজ শেষ হয়। ইনটেক চ্যানেল খনন কাজ হলেও বর্ষায় বড়ালে পানি আসেনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, দায়সারা কাজ করার কারণে নদী থেকে খনন করা বালু আবার নদীতে চলে গেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা মোজাম্মেল হক জানান, বিভিন্ন স্থানে স্লুইস গেট ও বাঁধ নির্মাণের ফলে বড়াল নদী শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। বর্ষায় নদীতে কিছু পানি জমলেও শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়। এবারও তাই হয়েছে। এলাকার কৃষকরা নদীর বুকজুড়ে আবাদ করেন। শুষ্ক মৌসুমে পরিণত হয় গবাদিপশুর চারণক্ষেত্র। এক সময় যে বড়ালের পানিতে নদী তীরবর্তী মানুষ তাদের জমিতে ফসল ফলাত, এখন সে নদীর বুকে অগভীর নলকূপ বসিয়ে হয় ধান চাষ। নদী আছে, নৌকা আছে, নেই শুধু পানি। স্থানীয় স্কুল শিক্ষক জাকারিয়া হোসেন জানান, এখনই সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করে নদীটি পুনঃখনন করা না হলে বড়াল নদীই এক দিন হারিয়ে যাবে মানচিত্র থেকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর