শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

কারণে অকারণে বাড়ছে পারিবারিক খুনাখুনি

সামাজিক অবক্ষয় ১

জিন্নাতুন নূর

অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করতে না পেরে বাবা নিজ সন্তানদের হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করছেন। আবার পরকীয়ার জেরে নিজ গর্ভের সন্তানকেই হত্যা করছেন মা। মাদকাসক্ত সন্তান নেশার জন্য অভিভাবকদের কাছে টাকা চেয়ে না পেয়ে হত্যা করছে জন্মদাতাকে। উদ্বেগজনক এই ঘটনাগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটেছে। প্রায়ই ঘটছে। উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতিকে বিশেষজ্ঞরা ‘সামাজিক ট্রমা’ নামে চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, অর্থের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত লোভে মানুষের ধৈর্যশক্তি কমে যাচ্ছে। এতে নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটছে। মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে মানসিক বিকৃতি। কোমল অনুভূতি লোপ পেয়ে পরিবারের সদস্যকেই হত্যার মতো পাশবিক অপরাধ ঘটাচ্ছে।

চাঁদপুর সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নে ১৭ ডিসেম্বর পারিবারিক কলহের জের ধরে স্ত্রী ফাতেমা আক্তারকে (২৫) বিষ খাইয়ে এবং পাঁচ বছরের মেয়ে ও এক বছর বয়সী ছেলেকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন মো. মাইনুদ্দিন। এরপর তিনি নিজেও গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। গত বছর নভেম্বরে পাওনাদার প্রতিবেশীকে ফাঁসাতে গিয়ে বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের সাপানিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সাবিয়া আক্তার অথৈকে (১১) শ্বাসরোধে হত্যা করেন তার বাবা কাজী গোলাম মোস্তফা। ওই বছরের এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পরকীয়ার জেরে নিজের ৯ বছরের পুত্রসন্তানকে শেফালী আক্তার নামের এক মা হত্যা করেন। শেফালীর স্বামী বাহরাইন প্রবাসী। নিজের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে ছোট দুই সন্তানকে কাঁথায় মুড়িয়ে আগুন দেন শেফালী। এতে বড় ছেলে দগ্ধ হয়ে মারা গেলেও ছোটটি বেঁচে যায়। একই বছর জুনে ঋণের বোঝা ও মামলায় পরাজিত হয়ে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার অটোরিকশাচালক কাজল মোল্লা (৩৫) তার দুই সন্তান কাকলী আক্তার (৮) ও সোহান মোল্লাকে (৫) ডোবার পানিতে চুবিয়ে হত্যা করে নিজে গলায় ফাঁস দেন। এপ্রিলে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে সন্তান জন্মের পর আজান না দেওয়ায় সাজু মিয়া (৩১) নামের এক ব্যক্তি নার্সিং হোমে নবজাতক ছেলেকে মাটিতে আছাড় দিয়ে হত্যা করেন। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ভারতীয় সিরিয়াল দেখে তাদের সংস্কৃতি অনুকরণ করে বাংলাদেশের পরিবারগুলোও তাদের মতো জীবন যাপনের চেষ্টা করছে। এতে পারিবারিক কলহ বাড়ছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তৈরি হচ্ছে বিশ্বাসহীনতা। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে তাদের সন্তানদের। এর সঙ্গে এ বিষয়ে রাষ্ট্রের উদাসীনতা ও মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া বিষণœতা ও মাদকাসক্তি এসব হত্যা ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিটি পরিবারেই ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা থাকে। আর অনেক কারণ একত্র হয়েই এ ধরনের হত্যাকা- সংঘটিত হয়। মানুষের মধ্যে ক্রমে সুস্থ বিনোদনের অভাব হওয়ায় তাদের আচরণেও ক্রমাগত পরিবর্তন ঘটছে। একই সঙ্গে প্রযুক্তির কারণে নর-নারীর মধ্যে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা কাজ করছে। আকাশ সংস্কৃতির কারণে মানহীন অনুষ্ঠান দেখে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একের প্রতি অপরের সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। মানুষ ক্রমেই সহিংস হয়ে পড়ছে। আর এ পরিস্থিতিতে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আপন মানুষটিকে হত্যা করছে। অথচ পারিবারিক এসব হত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা কার্যক্রম তৈরি করেনি। আর বিচারব্যবস্থার মুখোমুখি না হওয়ায় অপরাধী অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। আপন মানুষটিকে হত্যা করার আগেও তারা দুবার ভাবছে না। সামাজিক অপরাধ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে সমাজবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, সামনের দিনে এটি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। তাদের মতে, বিষণœতা এ ধরনের অপরাধ প্রবণতার জন্য দায়ী। আবার সামাজিক এসব অপরাধমূলক কর্মকান্ডের কেন্দ্রে রয়েছে অর্থ। মানুষ অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা ক্রমেই হারাচ্ছে। এতে মানুষ নিজে আত্মহত্যা করছে আবার পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার কথা ভেবে নিজ স্ত্রী ও সন্তানদেরও হত্যা করতে তারা দ্বিধা বোধ করছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সমস্যা এক দিনে তৈরি হয়নি। এটি প্রতিরোধে বাধ্যতামূলকভাবে সব সিটি, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে কাউন্সেলিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। স্থানীয় সরকার ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, জীবনযাত্রা ক্রমেই জটিল হয়ে পড়ছে। শহরে অসচ্ছল মানুষ গাদাগাদি করে থাকছেন। এতে মানুষের মনের পরিশুদ্ধ হওয়ার উপায় নেই। ফলে মানুষের মনোবিকৃতি বাড়ছে। তারা ক্রমেই পাশবিক হয়ে আপন মানুষটিকে হত্যা করছেন।

সর্বশেষ খবর