সোমবার, ৪ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
সামাজিক অবক্ষয় ৩

শিশু হত্যার শেষ কোথায়

শাস্তি না হওয়াতে বাড়ছে নিষ্ঠুর অপরাধ

জিন্নাতুন নূর

সামাজিক মূল্যবোধের প্রবল অবক্ষয়ের কারণে শিশুদের ভয়াবহ নৃশংসতার শিকার হতে হচ্ছে। শিশু হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়ায় শিশু নির্যাতন ও হত্যাকান্ডে র ঘটনাগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবস্থা এতই খারাপ যে, শিশুদের এখন নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। শিশু হত্যাকান্ডে র ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পারিবারিক কলহ, ধর্ষণের শিকার কন্যাশিশু, অপহরণের শিকার শিশু মুক্তিপণ না দিতে পেরে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যে গত বছর মোট ৪১৮ জন শিশু হত্যাকান্ডে র শিকার হয়। এর মধ্যে ৩১টি শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। আর ৮১টি শিশুর মৃতদেহ পাওয়া যায় হারিয়ে যাওয়ার পর। ৩৯টি পরিচয়হীন মৃত মানবভ্রƒণ পাওয়া যায়। ১২টি শিশু অ্যাসিড সহিংসতার শিকার হয়। ৫৩টি শিশু মা-বাবার মাধ্যমে নৃশংস হত্যাকান্ডে র শিকার হয়। ৬টি শিশুকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ১২ মাসে মোট ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৭১ জন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৪ জন। ২৮ জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর ৬০ জনকে হত্যা করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৫২ জন ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যাকান্ডে র শিকার হয় ৪ জন। জানুয়ারিতে ৪৩ শিশু হত্যাকান্ডে র শিকার হয়।  মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’র ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী সেই বছর প্রাপ্তবয়স্ক নারীর তুলনায় শিশুদের অধিকহারে ধর্ষণের শিকার হতে হয়। এদের মধ্যে অনেক শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে, ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১২ মাসে মোট ৫২১ শিশুকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ২২৯টি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। হত্যাকান্ডে র শিকার শিশুদের মধ্যে ১১৭ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর, আর ৬ বছরের নিচে শিশুর সংখ্যা ১১৮ জন।

গত বছর চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে তৃতীয় শ্রেণির ৯ বছরের এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করে হত্যার উদ্দেশে ছুরিকাঘাত করে সেফটিক ট্যাংকে ফেলে দেয় স্কুলের পিয়ন আপন চন্দ্র (৫৫)। করুণ পরিণতি শিকার হতে শিশু রাসেলকেও। গাজীপুরের চাচার গ্যারেজে থাকত এবং অটোরিকশা চার্জ দিত কিশোর মো. রাসেল। গত বছরের এপ্রিলে সেই গ্যারেজ থেকে দুর্বৃত্তরা অটোরিকশা চুরি করতে গেলে রাসেল তা দেখে ফেলে বাধা দেয়। এতে দুর্বৃত্তরা রাসেলকে শ্বাসরোধে এবং লোহা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। গত বছরের মে মাসে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মীরেরবাগ বালুর মাঠ এলাকার সোহাগ খান (১১) নামের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে কসমেটিক্স ব্যবসায়ী মো. শাহীন। কিন্তু মুক্তিপণ আদায় করতে না পেরে শিশুটিকে শ্বাসরোধে হত্যা করে শাহীন। পারিবারিক কলহের জেরে গাজীপুরের শ্রীপুরে ছয় বছরের কন্যাশিশুকে তার বাবা রফিকুল ইসলাম হত্যা করে খাটের নিচে পাতিলে লুকিয়ে রাখে। পরে পুলিশের কাছে কন্যার হত্যাকান্ডে র কথা স্বীকার করে রফিকুল। এ প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সামাজিক মূল্যবোধের প্রবল অবক্ষয়ের কারণে শিশুদের ভয়াবহ নৃশংসতার শিকার হতে হচ্ছে। আর এমনটি হচ্ছে সমাজের কিছু বিকৃত রুচির মানুষের কারণে। শিশু হত্যা ও নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের যথাযথ শাস্তি না হওয়ায় এ ধরনের অপরাধ রোধ করা যাচ্ছে না। এই নির্মমতা বন্ধ করতে ব্যাপকভাবে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, চিত্তবিনোদনের যথাযথ সুযোগের অভাবে মানুষের বিকৃতি বাড়ছে। তাদের কোমল অনুভূতি চলে যাচ্ছে এবং তারা ক্রমেই পাশবিক হয়ে শিশুদের হত্যা করছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকলে এমনটি হতো না। এখন রাজনৈতিক ক্যাডাররা সব নিয়ন্ত্রণ করছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধী অপরাধ করেও ভয় পাচ্ছে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর