বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

গাড়ির পাশেই ভয়ঙ্কর চক্র

মির্জা মেহেদী তমাল

গাড়ির পাশেই ভয়ঙ্কর চক্র

মিরপুরের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন। অফিসে যাওয়ার আগে তিনি নিজেই মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যান। সেদিন তার অনেক কাজ। তাই তার স্ত্রীকে বললেন তাদের মেয়ে ফারহানাকে স্কুলে দিয়ে আসতে। তিনি পথে নেমে যাবেন। বাসার গেটে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় আছেন ড্রাইভার বজলু। তারা তিনজন বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসেন। বজলু গাড়ি নিয়ে রওনা হন। পথে নেমে যান আলমগীর। পরে তার স্ত্রী মেয়েকে স্কুল গেটে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরছেন। মিরপুর ৬ নম্বরে একটি মার্কেটের সামনে চালককে গাড়ি থামাতে বলেন। কিছু কেনাকাটা করবেন। হাতে কিছু সময় আছে। বজলুকে মার্কেটের উল্টো দিকে রাস্তার পাশে পার্কিং করতে বললেন। মার্কেটের সামনে গাড়ি ঘুরে আসতে অনেক সময় লেগে যাবে। মিসেস আলমগীর রাস্তা পার হয়ে মার্কেটে গেলেন। আধা ঘণ্টা পর তিনি মার্কেট থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে যেতে রাস্তা পার হবেন। হঠাৎ তার গাড়ির দিকে চোখ পড়ল। তিনি দেখছেন, অপরিচিত এক লোক তার গাড়ি খুলে চালকের আসনে বসছে। তিনি বজলু বলে চিৎকার দিলেন। কিন্তু বজলু তো নেই কাছে। দৌড়ে রাস্তা পার হতে হতেই তার চোখের সামনে দিয়ে গাড়িটি সামনের দিকে সোজা চলে যাচ্ছে। তিনি শুধু বলছেন, এই আমার গাড়ি আমার গাড়ি। ভয়ে তার মুখ দিয়ে আর কোনো কথাই বেরুচ্ছিল না। পাশের একটি চায়ের দোকান থেকে তার ম্যাডামের কণ্ঠ পেয়ে বজলু ছুটে আসলেন। তিনিও হতভম্ব। লোকজনের ভিড়। মিসেস আলমগীর শুধু বলছেন, আমার গাড়ি নিয়ে গেল। চালক বজলু কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিছু বলতে পারছে না। শুধু বলছে, এক মিনিটও হয়নি আমি এই টং দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়েছি। কয়েকবার গাড়ির দিকে তাকিয়েছি। কিন্তু হঠাৎ এভাবে গাড়ি নিয়ে হাওয়া হবে কেউ, তা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। কী করবেন বুঝতে পারছেন না মিসেস আলমগীর। চোখের সামনে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল!! তার স্বামী আলমগীরকে ফোন দিলেন। তিনি মিটিংয়ে ছিলেন অফিসে। তিনি মিটিং ফেলে সেখানে চলে এলেন আধা ঘণ্টার মধ্যে। পুলিশকে জানালেন। পুলিশ ওয়্যারলেস ম্যাসেজ করে দিলেন। কিন্তু গাড়ির হদিস মিলল না। তবে ৫ দিন পর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে পরিত্যক্ত হিসেবে একটি গাড়ি উদ্ধার করে পুলিশ। আলমগীর শুনে তা নিজের বলে পুলিশকে জানায়। আলমগীর হোসেনের ভাগ্য ভালো ছিল। তাই তিনি গাড়িটি  ফেরত পেয়েছেন। কিন্তু রাজধানীতে এমন প্রতিদিনই গাড়ি চুরি হয়ে যাচ্ছে, কেউ পাচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে, কেউ কোনোদিনই আর খুঁজে পাচ্ছেন না। রাজধানীসহ সারা দেশের চিত্রই এখন এমন। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বিপণিবিতান, অফিস আদালতের পার্কিং থেকেই গাড়ি চোর চক্র গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছে। নিত্য নতুন কৌশলে তারা গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাড়ি চুরি রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও বাড়িয়েছে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না গাড়ি চুরি। যেন গাড়ির সামনেই গাড়ি চোর ওতপেতে বসে আছে। চোখের আড়াল হতেই মুহূর্তেই তারা গাড়ি নিয়ে হাওয়া। নানা কৌশলে এমনকি চালককে অচেতন করে একাধিক ভয়ঙ্কর গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটেছে। ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয় এমন অন্তত ২০টি গাড়ি চোর চক্রের তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গাড়ি চোর চক্রের প্রতিটি দলে ১০ থেকে ১২ জন করে সদস্য রয়েছে। বড় বড় শপিংমল ও মার্কেট এবং ব্যাংকসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পার্কিং করা গাড়ি টার্গেট করে মাস্টার কি দিয়ে বা তালা ভেঙে তারা গাড়ি চুরি করে। এরপর প্রত্যন্ত অঞ্চল, মফস্বল শহর ও সীমান্ত এলাকায় গাড়ি বিক্রি করে চোর চক্র। আরেক শ্রেণির গাড়ি চোর চক্র রয়েছে, যারা গাড়ি চুরি করে এবং সেই গাড়ি দিয়ে রাজপথে নানা অপরাধ করে বেড়ায়। তাদের কাজ শেষ হলে রাস্তায় ফেলে রেখে যায় গাড়ি। গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় তারা গাড়ি চুরির পর মালিকের কাছ থেকে মুক্তিপণও আদায় করে। চোর চক্রের প্রধান টার্গেট প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশা। গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকায় সক্রিয় ২০টি গাড়ি চোর চক্রের মধ্যে ইলিয়াস গ্রুপ, অলি গ্রুপ, বাবুল গ্রুপ, কানা শহিদ গ্রুপ, জামাল গ্রুপ, ছোট জামাল গ্রুপ ও শামীম গ্রুপ অন্যতম। গাড়ি পার্কিং করার পর মালিক ও চালককে অনুসরণ করে কয়েকজন সদস্য। কয়েকজন থাকে পার্কিং করা গাড়ির কাছাকাছি। চালককে অনুসরণকারীদের সিগন্যাল পেলেই গাড়ির কাছে থাকা সদস্যরা মাস্টার কি দিয়ে বা গাড়ির তালা ভেঙে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঢাকা ও এর আশপাশে আরও কয়েকটি ভয়ঙ্কর সিএনজি অটোরিকশা চোর চক্র সক্রিয় রয়েছে। চক্রের সদস্যরা অটোরিকশা চুরির টার্গেট নিয়ে যাত্রী সেজে গাড়ি ভাড়া করে। কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে তারা চালককে গাড়ি থেকে নামিয়ে অটোরিকশা চুরি করে পালিয়ে যায়। অনেক সময় গাড়ির চালককে অচেতন করে অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায়। এমনকি এ চক্রের সদস্যরা খাবারের সঙ্গে কৌশলে চেতনানাশক মিশিয়ে চালককে অচেতন করে অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায়। গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, ১৯ জানুয়ারি উত্তরা থেকে সিএনজি অটোরিকশা চোর চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।

তারা হলো- মো. অলি, তানভীর ইসলাম, নুর মোহাম্মদ, জাকির ওরফে আকবর, তাইজুউদ্দিন ওরফে মজিবুর রহমান ও শিপলু। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে দুটি চোরাই অটোরিকশা এবং চুরির কাজে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ চেতনানাশক ট্যাবলেট ও গুলের কৌটায় তরল চেতনানাশক জব্দ করা হয়। অভিনব কৌশলে তারা অটোরিকশা চুরি করে। ভোর অথবা গভীর রাতে তারা অটোরিকশা চুরি করে। চক্রের সদস্যরা গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা প্রথমে একটি অটোরিকশাকে টার্গেট করে। এরপর টার্গেট করা গাড়ির চালক কোথাও চা অথবা অন্য কিছু খাওয়ার সময় কৌশলে চেতনানাশক ট্যাবলেট খাইয়ে দেয়। চালক অচেতন হয়ে পড়লে রাস্তায় তাকে ফেলে দিয়ে অটোরিকশা নিয়ে তারা পালিয়ে যায়।

পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অজ্ঞাত ফোন নম্বর ব্যবহার করে গাড়ির মালিকের কাছে বিকাশের মাধ্যমে টাকা দাবি করে। ৭ থেকে ১০ দিন সময় নিয়ে মালিকের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা চালায়। চোরাই সিএনজি ফেরত দিতে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়। টাকা পাওয়ার পর কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় অটোরিকশা রেখে মালিককে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গাড়ি সঠিক স্থানেই পার্কিং করে রাখা দরকার। রাস্তার ধারে, ফুটপাথে গাড়ি পার্ক করলে একদিকে মানুষের যেমন চলাচলে সমস্যা হয়, তেমনি গাড়ি চুরির আশঙ্কাও থাকে। গাড়ি পার্ক করে রাখলেও চালকদের আরও সতর্ক থাকা দরকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর