বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
নদী বাঁচাও ৩৩

হারিয়ে যাচ্ছে শেরপুরের নদী

মাসুদ হাসান বাদল, শেরপুর

হারিয়ে যাচ্ছে শেরপুরের নদী

শেরপুর জেলায় একসময় অন্তত দেড় ডজন নদী ছিল। পাট ও ধান উৎপাদনকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্যে শেরপুরের সমৃদ্ধি ছিল। রেলপথবিহীন শেরপুরের সড়কপথে যোগাযোগ ছিল একেবারেই সীমিত। শেরপুরের ব্যবসা-বাণিজ্যের যাতায়াত ও যোগাযোগ হতো নদী পথ দিয়ে। ইতিহাস বলে- শেরপুরের নদী পথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও সম্পাদিত হতো। হাজারো মানুষের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম ছিল এসব নদী। জেলার সেই নদীগুলো আজ অস্তিত্ব সংকটে। নাব্য হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে অনেক নদী, খাল-বিল। নদীর বুক চিরে এখন চলছে ফসলের আবাদ। নির্মাণ করা হয়েছে ঘরবাড়িসহ নানা প্রতিষ্ঠান। কালের বিবর্তনে জেলার বেশ কয়েকটি প্রধান নদীর নামেরও পরিবর্তন হয়ে গেছে। প্রায় দেড়শ বছর আগের ইতিহাসে ১৬টি প্রধান নদী ও ৯টি ক্ষুদ্র নদীর কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন ঐতিহাসিক গ্রন্থে যে ১৬টি প্রধান নদীর নাম আছে সেগুলো হচ্ছে- ব্রহ্মপুত্র, মালিঝি, সোমেশ্বরী, মৃগী, নেত্রবতী, মহাঋষি, থলঙ্গ, ভোগবতী, খারুয়া, দর্শা, ভুরাঘাট, বলেশ্বরী, সুতি, মরাখড়িয়া, বৃদ্ধ ভোগবতী ও খড়িয়া। এগুলোর মধ্যে মরা বা আধামরা হয়ে ৮টি নদী এখনো কালের সাক্ষী হয়ে কোনো রকম বেঁচে রয়েছে। অন্য ৮টি নদী এখন শুধুই ইতিহাস। যে ৮টি নদী কোনো রকমে টিকে রয়েছে- তার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র, মৃগী, সোমেশ্বরী ও মালিঝি আগের নামেই এখনো পরিচিত। আর  যে  ৪টি নদীর নাম পরিবর্তন হয়েছে সেগুলো হলো- ভোগবতী থেকে ভোগাই, মহাঋষি থেকে মহারশি, থলঙ্গ থেকে চেল্লাখালী এবং নেত্রবতী থেকে নেতাই নদী। অন্য নদীগুলোর বিলুপ্তি ঘটেছে।

অন্যদিকে  ‘দশানি’ নামে নতুন একটি নদীর সৃষ্টি হয়েছে। শেরপুরের একসময়ের বিখ্যাত নেতাই নদী একদা নেতাই খালে রূপান্তরিত হয়, পরবর্তীতে তা একেবারেই হারিয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম এই নদীর নামও এখন আর জানে না। অথচ এই নেতাই সাবেক শেরপুর পরগনার মধ্যে ৪৩ মাইল দীর্ঘ নদ ছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। এ ছাড়া মৃগী নদীর দৈর্ঘ্য ২৯ মাইল, ব্রহ্মপুত্র নদ সাড়ে ১০ মাইল, মালিঝি সাড়ে ৩৫ মাইল, চেল্লাখালী ১২ মাইল, সোমেশ্বরী সাড়ে ১৮ মাইল, মহারশি ১৫ মাইল এবং ভোগাই নদী ১৬ মাইল দীর্ঘ ছিল। আর নকলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুতি নদীকে ঘিরে ব্রিটিশ আমলে চন্দ্রকোনায় গড়ে উঠেছিল বিশাল বন্দর। আজ সেই সুতি এখন প্রভাবশালীদের মৎস্য খামারে পরিণত হয়েছে। এখন নদীগুলো পরিমাপ করার অবস্থায় আর নেই। একসময়ের শেরপুর পৌর শহরের শান্ত স্নিগ্ধ মৃগী নদী এখন আধুনিক পৌর শহরের বর্জ্যরে আস্তানা। শহরের বিশাল ড্রেন নামিয়ে দেওয়া হয়েছে মৃগী নদীতে। বিলীন হয়েছে নদীর সুস্বাদু মিঠাপানির মাছ। পানির দুর্গন্ধে মৃগী এখন বিষাক্ত। হিমালয়ের মানস সরোবর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদটি চীন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ হয়ে শেরপুর জামালপুর সীমারেখায় প্রবহমান হয়েছে।  শেরপুর-জামালপুর অংশের এই ব্রহ্মপুত্র, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ নাম ধারণ করেছে। এই ব্রহ্মপুত্র নদ শেরপুর-জামালপুর জেলার বিশাল চরাঞ্চলের আশীর্বাদ ছিল। কালের পরিক্রমায় আজ এটি ছোট একটি খালের মতো হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতি বর্ষায় এটি অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। তখন এই ব্রহ্মপুত্র নদ আগ্রাসী রূপ ধারণ করে চরাঞ্চলকে বন্যায় ভাসিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরাপাহাড় থেকে কংস নদীর জন্ম হয়ে শেরপুরের হাতিবাগার এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারতে এর নাম কংস হলেও শেরপুররের নালিতাবাড়ীর হাতিবাগার এসে এ নদীর নাম হয়েছে ভোগাই। নালিতাবাড়ীর ৫ কিলোমিটার ভাটিতে দিংঘানা, চেল্লাখালী, মহাররি, মালিঝি ইত্যাদি বাহারি নামে উপ-নদীর নাম ধারণ করে আবার ভোগাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই ভোগাই নদী ময়মনসিংহের ফুলপুরের খড়িয়া নদীর সঙ্গে মিশে গেছে। খড়িয়া নদী আবার ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে। দীর্ঘদিনের দখল আর নানা উৎপাতে বাহারি নামের এই নদীগুলো আজ বিলীন হয়ে গেছে। 

এই অঞ্চলে একমাত্র ব্রহ্মপুত্র নদ ছাড়া সব নদীর উৎপত্তিস্থল প্রতিবেশী ভারত। ভারত থেকে গারো পাহাড় হয়ে শেরপুর দিয়ে মিশে গেছে অন্যান্য নদীতে। শেরপুুরের ইতিহাসের বিখ্যাত আকবরগ্রন্থ ‘নাগ বংশের ইতিবৃত্ত’ ও ‘শেরপুর টাউনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ বই সূত্রে জানা গেছে, ১৮৮৫, ১৮৯৭ এবং ১৯১৮ সালে এই অঞ্চলজুড়ে প্রবল ভূমিকম্প হয়। এর ফলে শেরপুরের বেশকিছু নদ-নদী, খাল-বিলসমূহের গতি পরিবর্তন ও ভরাট হয়ে যায়। তা ছাড়া উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে ব্রহ্মপুত্র, মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই, চেল্লাখালী নদীর স্থানে স্থানে অপরিকল্পিত বাঁধ, স্লুইস গেট নির্মাণের ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে আস্তে আস্তে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে চর জেগে ওঠে। কিন্তু নদী খননের কার্যকর কোনো উদ্যোগ-আয়োজন না থাকায় নাব্য হারিয়ে নদীগুলো আজ প্রবাহহীন। জেগে ওঠা চর চলে যায় প্রভাবশালীদের হাতে। নদীর বুকে চলে চাষাবাদ, গড়ে ওঠে বসতবাড়ি। নানা বিবর্তন পরিবর্তন প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নাব্য হারানো নদীগুলো এখন পরিণত হয়েছে সামান্য জলাধারে। নদী তার প্রাকৃতিক গতি হারানোর ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজপ্রাণী। শেরপুর জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডর উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আবদুল হান্নান দাবি করেন, সরকার এরই মধ্যে জেলা প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করে নদী-খাল দখলমুক্ত করতে কমিটি করেছে। সরকারের ডেল্টা বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে ২১০০ সালের মধ্যে সব নদী-খাল দখলমুক্ত ও পুনঃখনন শেষ করবে। ২০২০ সালের মধ্যে শেরপুরের বিখ্যাত মৃগী নদী, মালিঝি নদী ও ভৌলি বিল দখলমুক্ত এবং পুনঃখননের ব্যবস্থা করা হবে।

সর্বশেষ খবর