বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা

জোড়াতালি দিয়ে চলছে সবকিছু

ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতাল

কামরুজ্জামান সোহেল, ফরিদপুর

ফরিদপুরের ২১ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে ৯টি উপজেলায় গড়ে উঠেছে ৯টি হাসপাতাল। এর মধ্যে সালথা উপজেলার হাসপাতালটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় পড়ে আছে কয়েক বছর ধরে। ফলে সেই হাসপাতাল থেকে মানুষ এখনো কোনো চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। এ ছাড়া জেলা শহরে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল ও ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট অপর একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। এ জনপদের বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবার জন্য হাসপাতালগুলোতে যতটুকু চিকিৎসা-সুবিধা থাকার কথা, তার সিকিভাগও নেই। ফরিদপুর শহরে যে দুটি হাসপাতাল রয়েছে এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতাল। শহরের প্রাণকেন্দ্রে ১৯১৭ সালে তিন একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় এ হাসপাতালটি। শুরুতে ২৫ শয্যায় থাকলেও এখন তা বেড়ে ১০০ শয্যা করা হয়েছে। জেলা ও জেলার বাইরে থেকে আসা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে এখানকার চিকিৎসকদের। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির বেশির ভাগই নষ্ট। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক সংকট চলছে। হাসপাতালটিতে ৩৬ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে রয়েছেন মাত্র ১৯ জন। এর মধ্যে একজন রয়েছেন প্রশিক্ষণে, অপরজন প্রেষণে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় সিভিল সার্জন অফিসের দিবস পালন ও আনুষঙ্গিক কাজ করতে ব্যস্ত থাকতে হয় কয়েকজন চিকিৎসককে। যেসব পদ শূন্য রয়েছে এর মধ্যে রয়েছে সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থোপেডিকস), সিনিয়র কনসালটেন্ট (চর্ম ও যৌন), জুনিয়র কনসালটেন্ট (প্যাথলজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু)। তবে অ্যানেসথেটিস্ট, প্যাথলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট, দুজন সহকারী রেজিস্ট্রার (মেডিসিন), দুজন রেজিস্ট্রার (গাইনি), দুজন সহকারী রেজিস্ট্রার (সার্জারি) এ পদগুলো খালি রয়েছে। সাতজন মেডিকেল অফিসারের মধ্যে রয়েছেন ছয়জন। চারজন ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসারের মধ্যে রয়েছেন দুজন। নেই ব্লাডব্যাংক অফিসার, মেডিকেল অফিসার (আয়ুর্বেদি)। সেবক-সেবিকাদের মধ্যেও বেশ কয়েকটি পদ খালি রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রতিদিন হাসপাতালটিতে গড়ে দেড়শ রোগী অবস্থান করলেও তাদের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক অপর্যাপ্ত। প্রতিদিন রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। সরেজমিন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ৮০০ রোগী আসেন এ হাসপাতালে। এর মধ্যে বেশির ভাগই বহির্বিভাগের সেবা নিয়ে থাকেন। চিকিৎসক সংকট আর জনবল অপ্রতুল থাকায় রোগীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হাসপাতালটিতে অনিয়ম আর দুর্নীতি রয়েছে এমনটি জানালেন অনেকেই। দীর্ঘদিন ধরে দালালের পদচারণা রয়েছে এখানে। হাসপাতালের আশপাশের ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতালের দালালরা সব সময় ওত পেতে থাকেন। শহরের টেপাখোলা এলাকার জনৈক শফিকুল ইসলাম জানান, তিনি তার স্ত্রীকে এ হাসপাতালে নিয়ে যান। জরুরি বিভাগে থাকা চিকিৎসককে দেখানোর পর তাকে কয়েকটি টেস্ট দেওয়া হয়। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হতেই এক মহিলা দালাল তাকে পাশের এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে বলেন টেস্টের জন্য। যদি সেখান থেকে টেস্ট করানো হয় তাহলে ডাক্তার দেখানোর সব কাজ তিনি করে দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন ওই দালাল। এভাবেই প্রতিনিয়ত কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় চলছে দালালদের উৎপাত। হাসপাতালে ৫ টাকার বিনিময়ে রোগীদের স্লিপ দেওয়ায় কথা থাকলেও সেটি কোনো কোনো সময় নানা অজুহাতে ২০-৩০ টাকাও নেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া রোগীদের দেওয়া স্লিপ অনেক সময় ফটোকপি করে রেখে নতুন রোগীদের ধরিয়ে দেওয়া হয়। হাসপাতালে রোগী ও তাদের স্বজনদের মালামাল চুরির ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। রাতের বেলা হাসপাতালের পেছন দিকের অংশে মাদকসেবীদের আড্ডা দিতে দেখা যায়। হাসপাতালের খাবারের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রতিদিন তিন বেলা খাবারের জন্য ১২৫ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সকাল বেলা চিঁড়া, পাউরুটি, কলা, ডিম, আপেল দেওয়ার কথা থাকলেও বেশির ভাগ দিনই শুধু কলা-পাউরুটি দেওয়া হয়। দুপুরে ভাত, মাছ কিংবা মাংস, ডাল-সবজি দেওয়ার কথা থাকলেও মাংস দেওয়া হয় না। আবার যে মাছ দেওয়া হয় তা চাষের বলে রোগীরা মুখেও দেন না। টানা ১৬ বছর ধরে একই ঠিকাদার খাবার সাপ্লাই দিয়ে আসছেন। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালে একশ্রেণির দালালদের কারণে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা রোগীরা প্রতারিত হয়ে বেসরকারি ক্লিনিকে যেতে বাধ্য হন। এর মধ্যে অর্থোপেডিকস ও গাইনি বিভাগের রোগীরা বেশি প্রতারণার শিকার হন। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল থেকে যেসব ওষুধ বিনা মূল্যে দেওয়ার কথা, এর সিকিভাগও দেওয়া হয় না। ইচ্ছে করেই চিকিৎসকরা বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ লিখে থাকেন। ফলে রোগীর স্বজনরা বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য হন। ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. গণেশ কুমার আগরওয়ালা বলেন, হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্টাফ সংকট প্রকট। বিদ্যুতের অবস্থা খারাপ। দিনের অনেকটা সময় বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। ফলে অপারেশন থিয়েটারে কাজ করতে গিয়ে অসুবিধার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। হাসপাতালে একটি জেনারেটর খুবই দরকার। রোগীদের খাবারের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, খাবারের মান মোটামুটি।

সর্বশেষ খবর