বুধবার, ২০ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
নদী বাঁচাও ৩৫

হারিয়ে গেছে বারনই নদীর মাছ

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

হারিয়ে গেছে বারনই নদীর মাছ

দেবেন চন্দ্র জাল ফেলছেন। কিন্তু মাছ নেই। এর পরও ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সকাল থেকে এভাবে চলছে তার মাছ ধরার চেষ্টা। বেলা ১২টা নাগাদ মাছ পেয়েছেন আধা কেজিরও কম। এই মাছ বেচে চারজনের সংসারে ভাত তুলে দিতে হবে তাকে। দেবেন্দ্র চন্দ্র বললেন, ‘একসময় বারনই নদীতে মাছ ধরে পুরো সংসারের ব্যয় বহন করে জমা রাখা যেত। এখন তিন বেলা মুখে খাবার তুলে দেওয়া যায় না।’ এক দশক আগেও বারনই নদীর পানি ছিল টলটলে পরিষ্কার। নদীতে ছিল প্রচুর মাছ। কিন্তু এখন সেসব স্মৃতি। এখন দূষিত হয়ে উঠেছে রাজশাহীর পবা উপজেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত এ নদীটি। কারণ শহরের সব বর্জ্য নদীটিতে ফেলছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক)। ফলে নদীর দূষিত পানিতে এখন মেলে না কোনো মাছ। তাই বাধ্য হয়ে পেশা বদল করতে হচ্ছে নদীপাড়ের জেলেদের। বারনই নদীর পানি ব্যবহার করে এখন কোনো ফসলও ফলে না। এখন বর্ষাকাল পেরোলেই উৎকট গন্ধে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা কঠিন হয়ে ওঠে। শহরের ড্রেন দিয়ে নেমে যাওয়া কেমিক্যাল-মিশ্রিত বিষাক্ত বর্জ্য বারনইয়ের পানিকে এমন দুর্গন্ধময় আর দূষিত করে তুলেছে। পবার দুয়ারী ও মহানন্দখালী খাল হয়ে শহরের বর্জ্য গিয়ে মিশছে বারনই নদীতে।

মহানন্দখালী খালের পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা হালদারপাড়া গ্রাম। এই গ্রামে আগে ৬৫টি জেলে পরিবারের বসবাস ছিল। এখন প্রায় সবাই পেশা বদল করেছেন। ওই গ্রামের বাসিন্দা সুভাষ হালদার বলেন, খালের কালচে রঙের পানি গিয়ে মিশেছে বারনই নদীতে। এ কারণে নদীতেও মেলে না মাছ। তাই নদীনির্ভর জেলে সম্প্রদায়ের মানুষগুলো টিকে থাকার জন্য এখন অন্যের পুকুরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। অনেকে নিজ পেশা ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন।

প্রশান্ত হালদার বলেন, এক সময় বারনই নদীতে প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। তাদের জীবিকা নির্বাহে কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু এখন নদীর পানিতে একটি মাছও নেই। এই গ্রামের শিবু হালদারের ৩০ বছর কেটেছে পানিতে। খালে-নদীতে মাছ ধরতেন, বাজারে বিক্রি করতেন। ভালোই কাটত তার দিন। কিন্তু শিবু হালদার এখন ভালো নেই। তার হাতে জাল নেই। কয়েক বছর আগেই পেশা পরিবর্তন করতে হয়েছে তাকে। এখন তিনি ডাবের ব্যবসা করেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ডাব কেনেন, বাজারে বিক্রি করেন। এভাবে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয় শিবুকে। শিবু বলেন, নদীর পানি এতটাই দূষিত, সেখানে একটা মাছও বাঁচতে পারে না। শাকিমদুয়ারী গ্রামের কৃষক মজিবর রহমান জানান, গ্রীষ্মকালে নদীতে পানি কমে আসে। প্রখর রোদে তখন দূষিত পানি থেকে উৎকট গন্ধ ছড়ায়। এতে নদীর পাশের বাসিন্দাদের টেকাই মুশকিল হয়ে পড়ে। নদীর পানি দিয়ে ফসল চাষাবাদও করা যায় না। সেসব পানির সংস্পর্শে গেলেই শরীরজুড়ে দেখা দেয় চর্মরোগ। স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মাহবুবুর রহমান জানান, বারনই নদী ঘিরে গড়ে ওঠা জেলেদের জীবিকা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন এ অঞ্চলের মানুষ বিষিয়ে উঠেছে রাসিকের বিষাক্ত পানিতে। নদীর আশপাশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন নানা চর্মরোগে। বারনই নদী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক রহিমুদ্দিন বলেন, ‘দ্রুত রাজশাহী শহরসহ মেডিকেলের বিষাক্ত বর্জ্য বন্ধে কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে নদীপাড়ের মানুষসহ এ অঞ্চলের পরিবেশ বিপর্যয়সহ মানুষ ও প্রাণীর মহাসংকট অত্যাসন্ন।’ নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, সিটি করপোরেশনের আওতাধীন নগরীর তরল বর্জ্য পবার বারনই নদীতে পড়ছে। এই দূষিত বর্জ্যে মারা যাচ্ছে মাছ, মানুষজন আক্রান্ত হচ্ছেন নানা অসুখে, সেই সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রাজশাহী সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার উচিত নগরীর তরল বর্জ্য পরিশোধন করে নদীতে ফেলা। তা না হলে আগামীতে আরও বড় সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।

স্থানীয় এমপি আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ও কেমিক্যালযুক্ত পানি বারনই নদীসহ পবার খালে-বিলে এসে পড়ছে। কয়েক বছর ধরে বারনই নদীতে মাছ ছেড়েও লাভ হয়নি। পানি ট্রিটমেন্ট না করায় ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে আমাদের।’ রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, বর্জ্য শোধন করে নদীতে ফেলার একটি প্রকল্প তার আগের মেয়াদে নেওয়া হয়েছিল। সেই প্রকল্পটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তবে বারনই নদী বাঁচাতে প্রকল্পটি যাতে দ্রুত অনুমোদন পায় সে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর