সোমবার, ১ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

কৃষি জমি কমলেও বেড়েছে ধান উৎপাদন

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

কৃষি জমি কমলেও বেড়েছে ধান উৎপাদন

শুধু প্রযুক্তিতেই নয় কৃষিতেও এগিয়ে যাচ্ছে সমানতালে। বহুমুখী সমস্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেও এ খাতে এসেছে অভাবনীয় সাফল্য। দেশে দিনে দিনে কৃষি জমি কমলেও ধান উৎপাদন কমেনি। বরং উৎপাদন অনেক বেড়েছে। উৎপাদন সাফল্যের এই কৃতিত্ব দেশময় কর্মরত লাখ লাখ কৃষকের।   সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)সহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী এবং তাদের উদ্ভাবিত নতুন নতুন জাত। স্বাধীনতার আগে ও পরে দেশে কৃষি জমির পরিমাণ বেশি থাকলেও তখন ধানের উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি মেট্রিক টন। আর এখন উৎপাদন প্রায় ৩ কোটি ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। শুধু তাই নয়, ধান উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে চাল রপ্তানি করে বাংলাদেশ ছুঁয়েছে আরেকটি মাইলফলক।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ তথ্য মতে, বিশে^র ধান উৎপাদক সেরা দেশগুলোর শীর্ষস্থানে উঠেছে বাংলাদেশ। বিশ্বে অন্যতম ধান উৎপাদক দেশ হিসেবে সুখ্যাত ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশের অধিকাংশেরই ধান উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কমলেও বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম। ধান উৎপাদনে বিশ্বের বড় দুই দেশ ভারতের প্রবৃদ্ধি ছিল ২ শতাংশ ও চীনের দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির হারে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

কৃষির উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকা  ও জীবিকার ধারা। নতুন নতুন ধানের জাত উদ্ভাবনে অর্থনীতির নতুন এক দিগন্ত দেখছে দেশবাসী। বিশ্বে জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাত প্রথম উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীরা। ব্রি ৫টি জিংক জাত উদ্ভাবন করে তাক লাগিয়েছে সারা দুনিয়ায়। পাশাপাশি প্রোটিন, আয়রন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, গাবা ও প্রো-ভিটামিন-এ এবং লো-জিআই ধানসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর ধান উদ্ভাবনে ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে। আর এতে নতুন এক স্বপ্ন দেখাচ্ছে কৃষি খাত।

ব্রি এখন পর্যন্ত উচ্চফলনশীল ধানের ৯৪টি জাত উদ্ভাবন করেছে। খরা-বন্যা-লবণাক্ততা সহিষ্ণু, জিংকসমৃদ্ধ, প্রিমিয়াম কোয়ালিটি, ডায়াবেটিক ধানসহ অধিক উচ্চফলনশীল জাতের এসব ধানের উৎপাদন হারে বাংলাদেশ এখন অন্যসব দেশকে  পেছনে ফেলে শীর্ষস্থানে। ব্রি উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের ধান দেশের চাল উৎপাদনের শতকরা ৯১ ভাগই পূরণ করছে। যেখানে ৭০ দশকে বাংলাদেশে ধানের গড় ফলন ছিল হেক্টরপ্রতি ২ টনেরও নিচে। তা বেড়ে এখন হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হচ্ছে ৫ মেট্রিক টনেরও বেশি।

গবেষকরা বলছেন, কৃষি খাতে বিগত ১০ বছরে সঠিক নেতৃত্বেরই ফল এই অভূতপূর্ব সাফল্য। সার ও তেলের দাম কমানো, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষিতে প্রণোদনা প্রদান, সার বিতরণ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, উন্নতমানের ধানের বীজ সরবরাহ, বিভিন্ন ঘাতসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন ইত্যাদির ফলে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চালের উৎপাদন প্রতি বছর গড়ে ৪.৮৮ লাখ টন হারে বেড়েছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) পরিচালক (গবেষণা) ড. তমাল লতা আদিত্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্রির গবেষকদলের অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধার প্রয়োগ এবং সরকারের সহযোগিতায় উন্নত জাতের নতুন নতুন ধান উদ্ভাবিত করায় আজ দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ ধারাবাহিতা থাকলে চাল উৎপাদনে আমরাই বিশ্বকে নেতৃত্ব দেব। একই কথা বললেন উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. পার্থ সারথী বিশ্বাস।

জানা গেছে, উদ্ভাবিত খরাসহিষ্ণু জাতগুলো খরাপ্রবণ এলাকায় সম্প্রসারণের মাধ্যমে ৪% আবাদ এলাকা বৃদ্ধি পেয়েছে যেখান থেকে উৎপাদন বেড়েছে ১.৫%। লবণাক্ত সহনশীল জাতগুলো সম্প্রসারণের মাধ্যমে লবণাক্ত এলাকার ২৮ ভাগ এলাকা চাষের আওতায় এসেছে, উৎপাদন বেড়েছে ৭%। জলমগ্নতা সহনশীল জাতগুলো সম্প্রসারণের মাধ্যমে ২১% এলাকা চাষের আওতায় এসেছে যেখানে উৎপাদন বেড়েছে ৬.৩৯%। উপকূলীয় এলাকায় ধানের আবাদ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে জোয়ার-ভাটা সহনশীল ব্রি ধান৭৬ ও ৭৭ এবং জলমগ্নতা ও জলাবদ্ধতা সহনশীল ব্রি ধান৫২ অবমুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে উপকূলীয় এলাকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জমি ধানচাষের আওতায় এসেছে। সর্বোপরি ঘাত সহনশীল ও অনুকূল পরিবেশ উপযোগী জাতগুলোর আবাদ সম্প্রসারণের ফলে ২০১০-১৮ পর্যন্ত ৪.৮৮ লাখ টন হারে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০২১ সালের মধ্যে ৩ কোটি ৭০ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ব্রি উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধান ব্যবহারে কৃষকের মুখে আজ হাসি ফুটেছে। বছরের পর বছর দেশের চাষাবাদের জমি কমলেও ধান উৎপাদনে এগিয়ে গেছে দেশ। উৎপাদন বাড়াতে ব্রি প্রতি বছর প্রায় ১৫০ টন উচ্চ মানসম্পন্ন ধানবীজ কৃষকের মাঝে সরবরাহ করে। কৃষকের চাহিদামাফিক ভালো বীজ সরবরাহ করা হলে ২০২১ সালের মধ্যে ৩ কেটি ৭০ লাখ টন চাল উৎপাদন করা যাবে, যা থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, প্রতি বছর ১৫০ টন বীজ ব্রি থেকে এক হাজার লাইসেন্সধারী ডিলারের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। ডিলাররা যদি সঠিকভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে তা বিতরণ করেন এবং দেশে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি না হয়, তাহলে ২০২১ সালের মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ চাল বেশি উৎপাদন হবে। বর্তমানে আমরা ৩ কোটি ৪০ লাখ টন চাল উৎপাদনের টার্গেট নিয়ে কাজ করছি। তবে কৃষকদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়া গেলে ৩ কোটি ৭০ লাখ টন চাল উৎপাদন সম্ভব। বর্তমানে ব্রির গবেষকরা আরও ফলন বাড়ানোর জন্য ধানকে সি৩ থেকে সি৪ ধানে রূপান্তর করতে গবেষণা করছে। যাতে ফলন বর্তমানের চেয়ে ৫০ ভাগ বেশি হয়। এই ধান উৎপাদনে ৪০ ভাগ পানি কম লাগবে। সূত্র জানায়, ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে উৎপাদন ৪ কোটি ৭০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে।

সর্বশেষ খবর