শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রতারণা পূর্বাচল ট্রাস্ট সিটির

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রতারণা পূর্বাচল ট্রাস্ট সিটির

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ‘পূর্বাচল ট্রাস্ট সিটি’ নামে ভুঁইফোড় এক আবাসন কোম্পানির প্রতারণায় নিঃস্ব হয়েছেন সাত শতাধিক গ্রাহক। বাহারি সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে এসব গ্রাহকের কাছ থেকে এই প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক শ কোটি টাকা। ভুঁইফোড় এই প্রতিষ্ঠানের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে এখন প্লট বুঝে পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। ফেরত পাচ্ছেন না তাদের কষ্টার্জিত অর্থ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ২১ নম্বর সেক্টরের কাছে মাত্র ৯ বিঘা কেনা জমির বিপরীতে এই প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের কাছে বিক্রি করেছে ৩০০ বিঘা জমির তিন হাজার কাঠার প্লট। ভুঁইফোড় এই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন ও প্লট বিক্রিতে রাজউকের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও এখনো চলছে ‘ট্রাস্ট সিটি’র সব ধরনের কার্যক্রম। শতাধিক মামলা থাকার পরও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে জোরপূর্বক জমি দখল করে স্থানীয় বাসিন্দা ও কৃষকদের নিঃস্ব করার অপকৌশলে মেতে উঠেছে এই প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ভুঁইফোড় এই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচারসহ সব ধরনের অপতৎপরতা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন রাজউকের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের কুলিয়াদী ও রঘুরামপুর মৌজায় প্রকল্প দেখানো হয়েছে পূর্বাচল ট্রাস্ট সিটির। এই প্রকল্পের চেয়ারম্যান শারমিন সুলতানা লিপি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুল আলম। ২০১২ সালে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানের প্লট বিক্রি শুরু হয় ২০১৫ সালে। রাজউকের পূর্বাচল সিটির পাশে তুলনামূলক কম দামে প্লট পাওয়ার আশায় এই প্রতিষ্ঠানের ফাঁদে পা দেন গ্রাহকরা। বাহারি বিজ্ঞাপনে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে কাঠাপ্রতি ১০ লাখ টাকা মূল্যে সাত শতাধিক প্লট বিক্রি করেছে ট্রাস্ট সিটি। এরই মধ্যে এসব গ্রাহকের কাছ থেকে কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান। গ্রাহকদের দেখানো নকশা অনুযায়ী ট্রাস্ট সিটি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গেলে বানাতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়, খেলার মাঠ, লেক, রাস্তা, হাসপাতাল ও শপিং মল। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য ট্রাস্ট সিটির প্রয়োজন ৩০০ বিঘার বেশি জমি। কিন্তু প্রকল্প এলাকায় এই প্রতিষ্ঠানের জমি রয়েছে মাত্র ৯ বিঘা। তবে প্রকল্প এলাকায় ৫০ বিঘা জমি ক্রয় করার দাবি করেছেন ট্রাস্ট সিটির কর্মকর্তারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় জমির দালাল বেলায়েত হোসেন টিক্কা ভুয়া দাতা দিয়ে সাধারণ কৃষকের বহু জমি ট্রাস্ট সিটির কাছে হস্তান্তর করেছে। এ ছাড়া সাইনবোর্ড টাঙানোর শর্তে কৃষকদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া জমি গত চার বছরে প্লট আকারে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করেছে ট্রাস্ট সিটি। ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে দখলে রেখে বেশকিছু জমির প্লটও বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া ১৩৬ জন কৃষকের ১০০ বিঘা জমিতে জোরপূর্বক কোম্পানির সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিমুলিয়া এলাকার মুরাদ হাসান শিপনের ১৩ শতাংশ, রিপন মিয়ার ৩৯ শতাংশ, লুৎফর রহমানের ১৩ শতাংশ, সাজিদুর রহমানের ১৩ শতাংশ, মাজহারুল ইসলাম রতনের ২৩ শতাংশ, হ্যাপী আক্তারের ১৫ শতাংশ, লিলি আক্তারের ১৫ শতাংশ, মমতাজ বেগমের ১৫ শতাংশ, শফিকুর রহমানের ১৭ শতাংশ, বোরহানের ২১ শতাংশ, কাউসারের ১৪ শতাংশ জমিতে জোরপূর্বক বালু ভরাট করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া স্থানীয় সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ট্রাস্ট সিটি কুলিয়াদী মৌজার কুলিয়াদী এলাকার নাসির মিয়ার ২৭ শতাংশ, হাশেম মিয়ার ২৩ শতাংশ, আমজাদ হোসেনের ১০০ শতাংশ, আনোয়ার হোসেনের ১০০ শতাংশ, নান্নু মিয়ার ১০০ শতাংশ, ওহাব ভুঁইয়ার ১০০ শতাংশ, মোজাম্মেল ভুঁইয়ার ২৬ শতাংশ, আজিজুল হকের ১৩ শতাংশ, মোস্তফা মিয়ার ২৯ শতাংশ, ছালাম মিয়ার ৪৪ শতাংশ, হাসমত আলীর ৪৫ শতাংশ, শিমুলিয়ার হামিদ মিয়ার ১১ শতাংশ, রঘুরামপুর মৌজার রঘুরামপুর এলাকার ঈমান খানের ২২ শতাংশ, ফজলুল হক খানের ১২ শতাংশ, মোফাজ্জাল হোসেনের ২৬ শতাংশ এবং হারুনুর রশিদের ২৬ শতাংশ জমি দখলে নিয়েছে। এ ব্যাপারে কুলিয়াদী এলাকার মহিউদ্দিন, নুরজাহান, নুর আক্তার, নুরুজ্জামান, রঘুরামপুরের ঈমান আলী, শিমুলিয়ার মাজহারুল ইসলাম রতন, কামাল, কাউসার, মুরাদ হাসান শিপন, সফিকুর, রিপন, বোরহান, সানোয়ার, চোরাকাতলার ফজলুল হক ও রঘুরামপুর এলাকার আরমান মিয়া রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর ট্রাস্ট সিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগ দায়ের করায় মাজহারুল ইসলাম রতনের বিরুদ্ধে থানায় হয়রানিমূলক মামলা করেছে ট্রাস্ট সিটি। এ ছাড়া তার ভাই মুরাদ হাসান শিপনকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের সন্ত্রাসীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্রাস্ট সিটি প্রকল্পের এসব বেআইনি ও সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনার জন্য মাসিক চুক্তিতে সন্ত্রাসী ও মাস্তানদের লালন করা হয়। হিরনাল এলাকার তারা মিয়ার ছেলে হুমায়ুন কবির মিঠু ও তার সহযোগী কামরুল হাসান নয়ন, মোতাহার ফকির, হালিম মোল্লা, জামান, রেজু, শিবজন, বাবুল, ছলু, রুবেলসহ আরও অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী এলাকায় ট্রাস্ট সিটি নিয়ন্ত্রণ করে। প্রকল্প এলাকা দেখতে এলে গ্রাহকদের পাশেই দাঁড়ানো থাকে তারা। এলাকার কৃষকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে সাইনবোর্ড সাঁটানোর কাজও তারাই করে। ট্রাস্ট সিটি থেকে জমি কিনে প্লট না পেয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন শতাধিক গ্রাহক। ২০১৭ সালের ১২ জুলাই স্থানীয় ১৩৬ জন জমির মালিকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক ট্রাস্ট সিটির প্রকল্পে ন্যূনতম জমি না কিনে এবং রাজউকের অনুমোদন না নিয়ে সংস্থাটির বিজ্ঞাপন প্রচার, জমি দখল, বালু ভরাটসহ প্লট বিক্রির ওপর ২০১৭ সালের ১২ জুলাই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। রাজউক সচিব সুশান্ত চাকমার স্বাক্ষরিত সেই নিষেধাজ্ঞার অনুলিপি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়। রাজউকের এই নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এলাকার মাস্তান ও সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় অব্যাহত রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রম। এ ব্যাপারে ট্রাস্ট সিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুল আলম বলেন, ‘একটি বড় প্রকল্প তৈরি করতে গেলে কিছু ভুলত্র“টি থাকবেই। সঠিক হিসাব দেখাতে না পারলেও এলাকায় বহু জমি আমরা কিনেছি। সাত শতাধিক প্লটও বিক্রি হয়েছে। ২৫ জনের কাছে প্লট হস্তান্তরও করা হয়েছে।’

‘প্রকল্প এলাকার লোকজন ভালো নয়’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের বদনাম ও আমাদের হয়রানি করার জন্য তারা অপপ্রচার এবং মিথ্যা অভিযোগ করছে।’

মাস্তান পোষা প্রসঙ্গে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘একটি বড় প্রজেক্ট দাঁড় করাতে গেলে কিছু লোক পালতে হয়। ওরা সন্ত্রসী নয়, ওরা আমার স্টাফ।’

রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, ‘ভুঁইফোড় এই প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের অনুমোদন নেই। তাই গ্রাহকদের কাছে অনুরোধ রইল বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা না দেওয়ার জন্য। এদের সাইনবোর্ড অপসারণ করা হবে।’

সর্বশেষ খবর