শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

‘সালাম পার্টি’র ভয়ঙ্কর সালাম

মির্জা মেহেদী তমাল

‘সালাম পার্টি’র ভয়ঙ্কর সালাম

সন্ধ্যায় রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন কাকন। আগারগাঁও ষাট ফুট রাস্তা দিয়ে। আসসালামু আলাইকুম ভাই। পথচারী এক ছেলের এমন সালামে ভ্যাবাচ্যাকা খান কাকন। ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সালামের জবাব দিতে দিতে ছেলেটিকে পাশ কাটিয়ে রিকশা সামনের দিকে যেতে থাকে। পেছন ফিরে তাকান কাকন। নাহ, পরিচিত লাগছে না তো! কিন্তু ছেলেটি হাত উঁচিয়ে ইশারা দিচ্ছে। কাকন এবার রিকশা চালককে বলেন, এই থামো। রিকশা থেমে যায়। ছেলেটি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভাই ভালো আছেন! চিনেছেন আমাকে? কাকন তাকে চিনতে পারেননি।

তার চেহারার দিকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করছেন। ততক্ষণে আরও কয়েকজন রিকশার সামনে। তাদের দিকে চোখ ফেরাতেই ভয় পান কাকন। কী ব্যাপার? আপনারা কারা? আমাকে আপনারা চেনেন? আমি তো চিনতে পারছি না। স্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্টা করছেন কাকন। প্রথম ছেলেটি বলে, ভাই আপনি চিনতে না পারলেও আমরা চিনেছি। এ কথা বলেই হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করতে চায়। কাকন হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে। কিন্তু ছেলেটি হাত ছাড়ছে না। কাকন হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও পারে না। পাশের ছেলেগুলো এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যেন, অন্য কেউ দেখলে বুঝতে পারবে যে, সবাই এখানে পরিচিত। দেখা হয়ে যাওয়ায় কথা বলছে রিকশা থামিয়ে। কাকন বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন। তখনো কিছু বুঝতে পারেননি কাকন। হাত ধরে রাখা ছেলেটি হঠাৎ তার হাত টেনে তার কোমরের কাছে নেয়। কাকন তার হাতের স্পর্শে শক্ত কিছু অনুভব করে। বুঝতে বাকি থাকে না, সে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছে। ছেলেটির সাফ কথা, ভাই এত অভিনয় ভালো লাগে না। পকেটে যা আছে দিয়ে দেন। আমরা এ এলাকার। একটা কথা বলবেন, গুলি করে দেব। অযথা জান যাবে আপনার। বেশি কথা আমি পছন্দ করি না। কাকন ভয়ে তার পকেটে থাকা মানিবাগ, মোবাইল ফোন, আংটি যা ছিল সব দিয়ে দেন। ছেলেগুলো টাকা-পয়সা নিয়ে তাকে বলে, এই রিকশা নিয়ে চলে যান। পেছনে তাকালে গুলি হবে। আশপাশে আরও আমাদের ছেলেপেলে আছে। ওই সামনের মোড় পর্যন্ত যাবেন, পেছনে আমার ছেলেরা যাবে। তাই চালাকি, চিৎকার-চেঁচামেচি করলে খারাপ হবে আপনার। কাকন মাথা ঝুকিয়ে বলেন, আচ্ছা ভাই। তাকাব না। রিকশা ছেড়ে দেয়। কাকন রিকশা নিয়ে সোজা চলে যান। পেছনে তাকান না তিনি। কাউকে কিছু বলেননি। সোজা বাসায়। থানা পুলিশকেও জানাননি ভয়ে। রাজধানীর রাজপথে ভদ্রবেশী ছিনতাই গ্রুপ এভাবেই সাধারণ মানুষের টাকা-পয়সা লুটে নিচ্ছে। তারা ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। ব্যস্ত নগরীতে এভাবে যারা ছিনতাই কাজ করতে পারে, তারা অবশ্যই ভয়ঙ্কর। এমন ভেবেই ভুক্তভোগীরা কাউকে জানাতে চায় না। সংশ্লিষ্টরা বলছে, এমন ছিনতাইকারী গ্রুপকে সাধারণত সালাম পার্টি বলা হয়ে থাকে। তারা টার্গেট করা ব্যক্তিদের এমনভাবে সালাম দেয়, যেন খুব কাছের কেউ। যে কারণে যাত্রীরা রিকশা থামিয়ে কথা বলতে বাধ্য হয়। আর তখনই বিপদে পড়ে সাধারণ মানুষ। টাকা-পয়সা খুইয়ে বাসায় ফেরেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পলাশী, আজিমপুর, নিউমার্কেট, সদরঘাট, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর বসিলা, আগারগাঁও, মালিবাগ, মগবাজার, মিরপুরের দারুস সালাম, শাহ আলী, ১৪ নম্বর, কালশী, উত্তরার ৩ নম্বর ও দিয়াবাড়ীতেও ঘটছে এমন ঘটনা। ভুক্তভোগী ও স্থানীয়রা বলছে, প্রতিদিনই বিভিন্ন সময়ে ব্যস্ত রাস্তায়ই বেশি ছিনতাই হচ্ছে। ছিনতাইকারীরা কখনো সালাম দিয়ে থামাচ্ছে, কখনো গলির মধ্যে গাড়ি বা রিকশা আটকে অস্ত্র দেখাচ্ছে। তুচ্ছ কারণে ঝগড়া বাধিয়েও ছিনতাই করে কিছু চক্র। প্রাইভেট কার বা মোটরসাইকেল থেকে টান দিয়ে কিংবা ভিড়ের মধ্যে টান দিয়ে ব্যাগ নিয়ে নিচ্ছে কিছু ছিনতাইকারী। এদের পুলিশ ‘সালাম পার্টি’, ‘ঠেক পার্টি’ ও ‘টানা পার্টি’ বলছে।ঘটনার সূত্রে দেখা গেছে, ছিনতাইয়ে ভুক্তভোগীরা অল্প পরিমাণের টাকা, ব্যাগ, মোবাইল ফোন, ঘড়ি ও স্বর্ণালংকার খোয়াচ্ছেন। আগে ছিনতাইকারীদের দলে দু-তিনজন থাকলেও এখন পাঁচজনেরও বেশি থাকার তথ্য মিলছে। তারা নিজ মহল্লা বা পাশের মহল্লায় দল বেঁধে ছিনতাই করে। রক্তপাত বা সহিংস না হওয়ায় ভুক্তভোগীরা হাসপাতালে যাচ্ছে না। অনেকে ঝামেলা এড়াতে পুলিশের কাছেও অভিযোগ করছে না। কেউ কেউ অভিযোগ করলেও ঘটনাটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে নথিভুক্ত করে পুলিশ। অভিযোগ না হওয়ায় ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ তথ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। পুলিশের তল্লাশি টহলেও অনেকটা ঢিমেতাল। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে সালাম পার্টি। পান্থপথে হাবিবুল্লাহ বলেন, কয়েকদিন আগে সন্ধ্যায় স্কয়ার হাসপাতালের উল্টো পাশে ‘দাঁড়ান দাঁড়ান’ বলে রিকশা থামিয়ে তার এক হাজার টাকা নিয়ে যায় সাতজন। তাদের ছিনতাইকারী মনে হয়নি তার। গত ১ মার্চ সকালে মালিবাগ প্রথম লেনের ১৭৩ ও ১৭৪ বাড়ির মাঝামাঝি জায়গায় রিকশাযাত্রী মনির উদ্দিনের গলায় চাপাতি ঠেকিয়ে টাকা, মোবাইল ফোনসেট ও ব্যাংকের এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে এ ঘটনা ফেসবুকে ভাইরাল হয়। গত শুক্রবার মালিবাগের আতরবিবি লেন থেকে ইউসুফ আলী, ফরহাদ ফকির ও জসিম মাতব্বর নামের তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশের মতিঝিল বিভাগের সহকারী কমিশনার রাশেদ হাসান বলেন, ‘এ ঘটনায় ছয়জন ছিল। অপর তিনজনকে গেফতারের চেষ্টা চলছে। তারা পেশাদার ছিনতাইকারী ও ডাকাত।’ গত মাসে মিরপুরের শাহ আলী মার্কেটের আশপাশ থেকেই ২৯ ছিনতাইকারীকে আটক করেন র‌্যাব-৪-এর সদস্যরা। এদের মধ্যে পাঁচজনের বয়স ১৮ বছরের কম হওয়ায় তাদের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। তাদের কাছ থেকে নারীদের হাতব্যাগসহ ছিনতাই হওয়া বিভিন্ন সামগ্রী উদ্ধার করা হয়।

সর্বশেষ খবর