রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রতি ধাপেই কমছে ভোটার উপস্থিতি

উপজেলায় চার ধাপে আওয়ামী লীগ ৩১৬, বিনা ভোটে ১২২ স্বতন্ত্র ১৩১ (বিএনপি ৪) জাপা ৩, জেপির ১ চেয়ারম্যান

গোলাম রাব্বানী

সিটি করপোরেশন ও উপজেলা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারিয়েছেন ভোটাররা। ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভোটে কোনো কোনো কেন্দ্রে মাত্র ৩টি, ৫টি ভোটও পড়েছে। এ নির্বাচনে ১ শতাংশের কম ভোট পড়েছে ১০ কেন্দ্রে। ১ থেকে ৫ শতাংশ ভোট পড়েছে ৩২ কেন্দ্রে। ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোট পড়েছে ৪০ কেন্দ্রে।

একইভাবে এবারের উপজেলা নির্বাচনেও ভোটের প্রতি ভোটারের অনাগ্রহের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। উপজেলা ভোটে প্রথম ধাপে ৪৩ দশমিক ৩২, দ্বিতীয় ধাপে ৪১ দশমিক ২৫, তৃতীয় ধাপে ৪১ দশমিক ৪১ ও চতুর্থ ধাপে ৩৬ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। দেখা গেছে, প্রথম দিকে ভোটার উপস্থিতি গড়ে ৪০ শতাংশের বেশি হলেও চতুর্থ ধাপের উপজেলা ভোটে চেয়ারম্যান পদে ৩৬ দশমিক ৫০ ভাগ ভোট পড়ে, যা আগের তিন ধাপের গড় ভোটের হারের চেয়ে ৪ ভাগ কম। চার ধাপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, উপজেলায় সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে দ্বিতীয় ধাপে সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় ৮ দশমিক ৬৩ ও জৈন্তাপুরে ৯ দশমিক ৩৮ ভাগ। এ ছাড়া প্রথম ধাপে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় ভোট পড়েছে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। চতুর্থ ধাপে ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ পড়েছে ফেনী সদর উপজেলায়। তৃতীয় ধাপে ভোট পড়েছে লক্ষ্মীপুর সদরে ১৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। ইসির দেওয়া ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চার ধাপে আওয়ামী লীগ থেকে চেয়ারম্যান হয়েছেন মোট ৩১৬ জন। এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় (বিনা ভোটে) ১২২ জন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান হয়েছেন ১৩১ জন। এর মধ্যে বিএনপির ৪ জন বহিষ্কৃত নেতাও রয়েছেন। সেই সঙ্গে এবারে জাতীয় পার্টির ৩ ও জেপির ১ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

এবার বিনা ভোটে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান হয়েছেন ১২২ জন। আর তিন পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ৩০ উপজেলায় ভোটের প্রয়োজন পড়েনি। ১৭ উপজেলার ভোট স্থগিত করা হয়। এর মধ্যে ১০টি আদালতের আদেশে ও ৭টি ইসির আদেশে।

এদিকে বিএনপিসহ অধিকাংশ দলের বর্জনে এবারের উপজেলা নির্বাচন জৌলুসহীন হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। ২০১৪ সালে সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে গড়ে ৬১ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ২০০৯ সালে ভোটের হার ছিল ৬৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ভোটার উপস্থিতি তুলনামূলক কম হওয়া নিয়ে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে গেলে অনিয়ম বাড়ত। প্রকৃত কত লোক কেন্দ্রে আসে, সেটাই চেয়েছি।’ ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার ব্যাখ্যায় তিনি জানান, ‘অনেক রাজনৈতিক দল স্থানীয় এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আবার যারা অংশ নিয়েছে, তাদের স্বতঃস্ফূর্ততার কারণে এ ভোটের হার হয়েছে। এটা তাদের সমর্থকগোষ্ঠীর ভোট বলা যেতে পারে।’ সচিব বলেন, ‘প্রতিটি ধাপে আমরা চেয়েছি ভোট যেন শান্তিপূর্ণ হয়; প্রাণহানি যেন না হয়; অনিয়ম যেন না হয়। এতে কমিশন সন্তুষ্ট।’

প্রথম ধাপ : আওয়ামী লীগ-৫৯, স্বতন্ত্র-বিদ্রোহী-২৩ (বিএনপি-২) : প্রথম ধাপে ১০ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৮২ উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান হয়েছেন ৫৯ জন, এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৭ জন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র-আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ২৩ জন (স্বতন্ত্র বিএনপি-২) চেয়ারম্যান হয়েছেন। এ ধাপের ৮২ উপজেলার মধ্যে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে ৭৯ উপজেলায়, আবার চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ১৪ উপজেলায় ওই পদে ভোট হয়নি। এ ছাড়া ৩ উপজেলার সব পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ওই ৩ উপজেলা ভোটবিহীন ছিল। প্রথম ধাপে ৪৩ দশমিক ৩২ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় সর্বনিম্ন ভোট পড়েছে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। আর পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলায় সর্বোচ্চ ৭১ দশমিক ১৬ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছেন ইসির কর্মকর্তারা।

দ্বিতীয় ধাপ : আওয়ামী লীগ-৮০, স্বতন্ত্র-বিদ্রোহী-৩৮ (বিএনপি-১), জাপা-২ : ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ১২০ উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান হয়েছেন ৮০ জন। এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২৯ জন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র-আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ৩৮ জন (স্বতন্ত্র বিএনপি-১) ও জাতীয় পার্টির ২ জন চেয়ারম্যান হয়েছেন। এ ধাপের ১২০ উপজেলার মধ্যে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে ১১৪ উপজেলায়। আবার চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ২৩ উপজেলায় ওই পদে ভোট হয়নি। এ ছাড়া ৬ উপজেলার সব পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ওই ৬ উপজেলাও ভোটবিহীন ছিল। দ্বিতীয় ধাপে ভোটারশূন্য কেন্দ্র থাকলেও গড়ে ৪১ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলায় সর্বোচ্চ ৭৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় সর্বনিম্ন ভোট পড়েছে ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। সেই সঙ্গে সিলেটের জৈন্তাপুরে ভোট পড়েছে ৯ দশমিক ৩৮, গোয়াইনঘাটে ১৬ দশমিক ৫৩ ও বগুড়া সদর উপজেলায় ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ ছাড়া খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ভোট পড়েছে ৭৮ দশমিক ১২ ও ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে ৭১ দশমিক ৪১ শতাংশ।

তৃতীয় ধাপ : আওয়ামী লীগ-৮৯, স্বতন্ত্র-বিদ্রোহী-৩৮, জাপা-১ : ২৪ মার্চ অনুষ্ঠিত তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে ১২৮ উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান হয়েছেন ৮৯ জন, এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৩৭ জন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র-আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ৩৮ ও জাতীয় পার্টির ১ জন চেয়ারম্যান হয়েছেন। এ ধাপের ১২৮ উপজেলার মধ্যে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে ১২২টিতে। আবার চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ৩১ উপজেলায় ওই পদে ভোট হয়নি। এ ছাড়া ৬ উপজেলার সব পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ওই ৬ উপজেলাও ভোটবিহীন ছিল। এ ধাপে আগের রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখার অভিযোগে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার পুরো নির্বাচন স্থগিত করে কমিশন।

তৃতীয় ধাপ ভোটারশূন্য থাকলেও ব্যালট বক্সে ভোট পড়েছে ৪০ দশমিক ৪১ শতাংশ। এর মধ্যে এ ধাপে ১২২ উপজেলার মধ্যে ২৭টিতে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। এ ধাপে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে ৭২ দশমিক ৯১ শতাংশ। আর সর্বনিম্ন লক্ষ্মীপুর সদরে ১৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ভোট পড়েছে ৬২ দশমিক ২২, ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডে  ৬১ দশমিক ৯৩, শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে ৬০ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এ ছাড়া ৫৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলায়, সাতক্ষীরার কলারোয়ায় ভোট পড়েছে ৫৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।

চতুর্থ ধাপ : আওয়ামী লীগ-৮৮, স্বতন্ত্র-বিদ্রোহী-৩২ (বিএনপি-১) : ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পাশাপাশি দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। অনেক এলাকায় নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। চতুর্থ ধাপে ১২১ উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান হয়েছেন ৮৮ জন। এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৩৯ জন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র-আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ৩২ জন (স্বতন্ত্র বিএনপি-১) ও জাতীয় পার্টির (জেপি) ১ জন চেয়ারম্যান হয়েছেন। এ ধাপের ১২১ উপজেলার মধ্যে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে ১০৬টিতে। আবার চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ২৪ উপজেলায় ওই পদে ভোট হয়নি। এ ছাড়া সব পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ১৫ উপজেলাও ভোটবিহীন ছিল। এ ছাড়া এ ধাপে আগের রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখার অভিযোগে কুমিল্লার তিতাস উপজেলার পুরো নির্বাচন স্থগিত করে কমিশন।

চতুর্থ ধাপে ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ ধাপে সর্বনিম্ন ভোট ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ পড়েছে ফেনী সদর উপজেলায়। আর এ উপজেলায় ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ৭০ দশমিক ৮২ শতাংশ ভোট পড়েছে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায়। ভোটারশূন্য কেন্দ্র দেখা গেলেও ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ১১ উপজেলায়। এ ছাড়া ৩০ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে ১৪ উপজেলায়। আর ২০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে ৩ উপজেলায়। এর মধ্যে সর্বনিম্ন ভোট পড়েছে ফেনী সদর উপজেলায় ১৩ দশমিক ৫০, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ১৩ দশমিক ৫৯ ও নরসিংদী সদরে ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ।

 

সর্বশেষ খবর