রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রকল্পের অর্থ ছাড় ও ব্যবহারে সর্বময় ক্ষমতা পেলেন পিডিরা

নাখোশ বিশ্বব্যাংক আইএমএফ

মানিক মুনতাসির

উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ছাড়ের সর্বময় ক্ষমতা পেলেন প্রকল্প পরিচালকরা (পিডি)। এখন থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় বা প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমোদন বা সম্মতি ছাড়াই সরকারি তহবিলের (জিওবি) অংশের শতভাগ অর্থ ছাড় করতে পারবেন তারা। এমনকি ইচ্ছামতো খরচও করতে পারবেন। এর জন্য অর্থ মন্ত্রণায় বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের কাছে কোনো জবাবদিহিতা করতে হবে না। তবে কোনো বিল বা ভাউচারের বিপরীতে কোনো অডিট আপত্তি আসা সাপেক্ষে তা নিষ্পত্তিতে পিডিদের কিছুটা জবাবদিহিতা করতে হতে পারে। গত ৩১ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট অনুবিভাগ-১ থেকে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্প ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বিঘিœত হবে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ছাড় করা হয় চারটি কিস্তিতে। যার জন্য অর্থবিভাগ ও প্রকল্প সংশ্লিøষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক বিভাগের অনুমোদন  নেওয়ার বাধ্যবাধতা ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রকল্প ব্যয়ের ক্ষেত্রে অধিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রকল্পের কাজে গতি আনতে চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল পিডিদের। আর তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করতে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক বিভাগের অনুমোদন প্রয়োজন হতো। কিন্তু এতেও প্রকল্পের কাজে ধীরগতি কাটছে না এবং নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে পিডিদের এমন যুক্তির ভিত্তিতে অর্থ ছাড় ও ব্যবহারের সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পিডিদের। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে উষ্মা প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটা হয়তো প্রকল্পের কাজে গতি বাড়ানোর জন্য করা হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা কিছুটা দুরূহ হয়ে পড়বে। কেননা অর্থ ছাড়ের সময়ে পিডিদের কিছুটা জবাবদিহিতার আওতায় রাখার সুযোগ ছিল। কিন্তু এখন পুরো অর্থ খরচ করে ফেলার পর অডিট আপত্তি পাওয়া সাপেক্ষে ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে- এমন সিদ্ধান্তে মূলত স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতাকেই বিঘিœত করার আশঙ্কা থাকে। তবে প্রকল্প পরিচালকরা হয়তো নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে সব ধরনের ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এতে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ঘাটতি বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। সংস্থাটি এ বিষয়ে পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে বলে জানান তিনি। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি বাংলাদেশ ভিজিট করে যাওয়া আইএমএফের একটি টিম এ বিষয়ে সরকারকে মৌখিকভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বলে অর্থবিভাগের একটি সূত্র জানায়। এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যদি অর্থ ছাড় প্রক্রিয়া সহজ করতে এবং কাজের গতি বাড়াতে গিয়ে সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয় এতে দুর্নীতি আরও বাড়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে অর্থ ছাড় সহজ করার পাশাপাশি সেখানে একটা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও থাকতে হবে, যা জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। তবেই কেবল দুর্নীতি কমানো যাবে। তবে সরকার বলছে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন গতিশীল করতে অর্থ ছাড় ও ব্যবহার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন থেকে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের কোষাগার থেকে বরাদ্দকৃত অর্থের পুরো অংশ পরিচালকরাই ছাড় করতে পারবেন। এ জন্য অর্থবিভাগ কিংবা প্রকল্পের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে না। তবে প্রকল্পের শুল্ক ও ভ্যাট এবং ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ব্যয়ে যে অর্থের প্রয়োজন হবে তা প্রকল্প পরিচালকরা ছাড় করতে পারবেন না। আর প্রকল্প সাহায্যের বর্তমান যে নিয়ম রয়েছে তা-ই বহাল থাকবে। অর্থাৎ ঋণ ও অনুদান দাতা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার শর্ত এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে অর্থ ছাড় হবে। ৩১ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সংশোধিত কর্তৃত্ব অনুযায়ী মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অধিদফতর/ পরিদফতর/অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন অনুমোদিত প্রকল্পের জিওবি অংশের বরাদ্দের অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে অর্থবিভাগ এবং প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়/বিভাগের কোনো সম্মতির প্রয়োজন হবে না। ওই অর্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছাড় হয়েছে বলে গণ্য হবে। প্রকল্প পরিচালকরা এ অর্থ সরাসরি ব্যবহার করতে পারবেন। জানা গেছে, সাধারণত সরকার বাজেটে উন্নয়ন ব্যয়ের যে পরিকল্পনা করে, তা প্রকল্পভিত্তিক হয়ে থাকে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে একজন করে প্রকল্প পরিচালক থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি একাধিক প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। প্রকল্পগুলোর কোন খাতে কত খরচ হবে তা অনুমোদনের সময়ই নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। দরপত্র আহ্বান করে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয় মালপত্র কেনাকাটা, অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ করা হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বরাদ্দ করা অর্থ ছাড়ের অনুমোদন দেয়। এর সঙ্গে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ও সম্পৃক্ত। অর্থবছরকে চারটি ত্রৈমাসিকে ভাগ করে চার কিস্তিতে অর্থ ছাড় করা হয়। এসব কেনাকাটা, বিল-ভাউচারে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে অর্থবিভাগের অনুমোদনক্রমে অর্থ ছাড় করার নিয়ম রয়েছে। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করেন প্রকল্প পরিচালক। এখন থেকে মন্ত্রণালয়ের কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই অর্থ ছাড় ও ব্যবহার করতে পারবেন প্রকল্প পরিচালকরা।

সর্বশেষ খবর