রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা
নদী বাঁচাও ৫০

মৃতপ্রায় সুরমা ভাটির ছয় নদী

মাসুম হেলাল, সুনামগঞ্জ

মৃতপ্রায় সুরমা ভাটির ছয় নদী

সুনামগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়- প্রথমত পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী, যেগুলো পাহাড়ি নদী কিংবা ছড়া হিসেবেও পরিচিত; দ্বিতীয়ত সুরমা-ভাটি অথবা দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত নদী। প্রতিবছর বর্ষায় পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে উত্তরের নদীগুলো নাব্যতা কোনোমতে ধরে রাখতে পারলেও পাহাড় থেকে নেমে আসা পলিমাটি জমতে জমতে দক্ষিণের নদীগুলো মৃতপ্রায়। আর দক্ষিণের বড় একটি নদীকে হাওরের ফসল রক্ষার             জন্য স্থায়ী বাঁধ দিয়ে চিরতরে মেরে ফেলা হয়েছে। প্রসঙ্গত, জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে সুনামগঞ্জে ২৬টি ছোট-বড় নদী রয়েছে। সুনামগঞ্জের প্রধান নদী সুরমা মেঘালয় থেকে এসে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। বরাকের মূল স্রোতের সঙ্গে উত্তর থেকে নেমে আসা পাহাড়ি নদীগুলো সুরমার নাব্যতাকে পরিপূর্ণ করেছে। তেমনি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত সুরমা থেকে উৎপন্ন সুরমা-ভাটির নদীগুলো বিস্তৃত সমতল ও হাওর এলাকাকে করেছে সবুজ-শ্যামল, শস্যদাত্রী। সুরমা-ভাটির নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মরা সুরমা, পান্ডার খাল, গোয়ারাইর খাল, মাছুখালী ইত্যাদি। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হওয়ার সময় নতুন নামেও পরিচিতি পেয়েছে কোনো কোনো নদী। যেমন পান্ডার খালের দক্ষিণ-পশ্চিমের অংশ মহাসিং নদী নামে পরিচিত। তেমনি দিরাই উপজেলায় গিয়ে মরা সুরমার একাংশের নাম কালনী হয়েছে। পাহাড় থেকে নেমে আসা পলি জমতে জমতে সুরমা-ভাটির এসব নদীর সবই নাব্যতা হারিয়ে এখন মৃতপ্রায়। একসময়ের উত্তাল যৌবনা নদীগুলোর কোনো কোনো অংশ শুকিয়ে হেমন্তে গোচারণভূমিতে রূপ নেয়। কোনো কোনোটি হারিয়ে গেছে হাওরের বোরো জমিতে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ জানায়, সুরমা নদী সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার পৈন্দা এলাকায় এসে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট একটি ধারা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে চলে যায় দিরাইয়ের দিকে; অপরটি উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে জামালগঞ্জ হয়ে গিয়ে মেশে মেঘনায়। দক্ষিণ-পশ্চিমের ধারাটি নিকট অতীতে ছিল সুরমার মূল স্রোতধারা। কিন্তু পলি জমে ভরাট হতে হতে বদলে গেছে একসময়ের স্রোতস্বিনী এই নদীটির দৃশ্যপট। বর্ষায় কোনোমতে নাব্যতা টিকে থাকলেও হেমন্তে নদীটি হয়ে পড়ে মৃতপ্রায়, যে কারণে সুরমার মূলধারা এখন সাধারণ মানুষের কাছে ‘মরা সুরমা’ হিসেবে পরিচিত। সরেজিমন ঘুরে দেখা যায়, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নারায়ণপুর গ্রাম থেকে দিরাই উপজেলার শরিফপুর পর্যন্ত ১০-১২ কিলোমিটার নদী ভরাট হয়ে গেছে। রাজানগর ইউনিয়নের গচিয়া থেকে নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর পর্যন্ত নদীর অনেক জায়গায় পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। এদিকে সুরমার অপর বড় শাখানদী পান্ডার খাল, যেটি দোয়ারাবাজার উপজেলার ইদনপুর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ও জগন্নাথপুর উপজেলা হয়ে প্রায় শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মিশেছে কুশিয়ারা নদীতে। ১৯৭২ সালে দেখারহাওরসহ দক্ষিণের অনেক হাওরের ফসল আগাম বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নদীটিতে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এর পর থেকে মরে যায় পান্ডার খাল। পান্ডার খাল মরে যাওয়ার পর মহাসিং হিসেবে পরিচিত এটির দক্ষিণের অংশ সুরমা থেকে আসা ছোট অপর কয়েকটি নদী ও খালের পানিতে বর্ষায় তিরতিরিয়ে প্রবাহিত হতো। গোরারাইর খাল, মাছুখালী হিসেবে পরিচিত ওই নদীগুলোও পলিতে ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে মহাসিং নদীটি এখন বর্ষায়ও মৃতপ্রায়। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার সিচনি গ্রামের কৃষক সুহেল মিয়া বলেন, ‘বীরগাঁও গ্রামের পশ্চিমে উক্তিরখাল এলাকায় মহাসিং নদী একেবারে ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীটি প্রকৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে। ওই অংশসহ পুরো নদীটি খনন করে দিলে এটি নাব্যতা ফিরে পাবে। এতে এ এলাকার কৃষি, পরিবেশ ও নৌ-যোগাযোগ লাভবান হবে।’ স্থানীয়রা জানান, সুনামগঞ্জের সুরমা-ভাটির নদীগুলো ভরাট হওয়ার কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জেলার কৃষি, মৎস্য উৎপাদনসহ হাওরে পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর। নদীতে পানি না থাকায় বোরো আবাদের জন্য পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন না কৃষক। গভীর-অগভীর নলকূপগুলোতে পানি উঠছে না। ব্যাহত হচ্ছে সবুজায়ন। গাছপালার বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ফলদ গাছের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে পানিশূন্যতার কারণে।

অপরদিকে নদীকে কেন্দ্র করে আবহমান কাল থেকে হাওরাঞ্চলে গড়ে ওঠা নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে সুরমা-ভাটির নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে। এতে মানুষের ভোগান্তির পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গিয়ে হাওরের ওপর দিয়ে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণ হচ্ছে। ফলে হাওরের প্রতিবেশ, প্রতিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ধ্বংস হচ্ছে মাছের উৎপাদন ও বংশবিস্তার। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ)-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী খুশি মোহন সরকার বলেন, ‘পলি পড়ার কারণে অনেকগুলো নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। মরা সুরমা নদীর দিরাই ও শাল্লা অংশের ৪০ কিলোমিটারে খনন কাজ চলছে। এর মধ্যে ২৮ কিলোমিটার খনন কাজ শেষ হয়েছে। উজানে আরও ৩১ কিলোমিটার খনন করার জন্য প্রাক্কলন তৈরি করা হয়েছে। সম্পূর্ণ খনন কাজ শেষ হলে জেলার অন্যতম বৃহৎ এই নদীটি নাব্যতা ফিরে পাবে। তিনি বলেন, ‘ভরাট হয়ে যাওয়া সব নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে খননের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।’

সর্বশেষ খবর