সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

সোনার কলসের খোঁজে

মির্জা মেহেদী তমাল

সোনার কলসের খোঁজে

ফরিদপুরের কৃষ্ণনগরের একটি গ্রাম শ্যামসুন্দরপুর। সেই গ্রামে রয়েছে ফকিরি আস্তানা। ইছহাক প্রামাণিককে ঘিরেই এই আস্তানা গড়ে তোলা হয়েছে। এলাকার লোকজনের কাছে ইছহাক প্রামাণিক বেশ কামেলদার মানুষ। দূর-দূরান্ত থেকে শত শত মানুষ তার আস্তানায় যাতায়াত করেন। বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেয় ইছহাক ফকির। তবে, তার কেরামতিতে অনেকেই ধনী হয়েছেন, এমন কথা চাউর আছে এলাকায় লোকজনের মুখে।  কেউ কেউ বলেন, তার কাছে গুপ্তধন আছে। তার আস্তানা ঘিরে বিভিন্ন দোকানপাট খুলে ব্যবসা করছেন কেউ কেউ। হঠাৎ হঠাৎ তিনি আস্তানা থেকে হাওয়া। কেউ জানে না, কোথায় যায় ইছহাক ফকির। তার লোকজন বিভিন্ন ধরনের কথা বলে ওই সময়ে। তবে ইছহাক ফকির তার আস্তানা থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন  জেলায় যায়। সেখানে তিনি মানুষের সমস্যার সমাধানের পথ দেখায়। গুপ্তধনের খোঁজখবর দেয়। অল্প সময়ে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া ইছহাক ফকির নিজেও গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে বলে স্থানীয়রা বিশ্বাস করে।

হঠাৎ একদিন কিছু লোকজন ইছহাক ফকিরকে ধরে নিয়ে আসে ফরিদপুর থানায়। তাকে তুলে দেয় পুলিশের হাতে। পুলিশ এরপর তার আস্তানায় তল্লাশি চালায়। তছনছ করে। তবে তার গ্রেফতারে স্থানীয়রা অবাক। ইছহাক ফকির কামেলদার লোক। কেন তাকে গ্রেফতার করা হলো, তা জানার আগ্রহ সৃষ্টি করে স্থানীয়দের মনে। পুলিশ ইছহাক ফকিরের  বিষয়ে যখন বলতে শুরু করে স্থানীয়রা তখন হতবাক। ফকিরের ছদ্মবেশে যে লোকটি আস্তানা গেড়েছিল, সে একজন প্রতারক। ফাঁদ পেতে মানুষের কাছ থেকে টাকা লোপাট করাই তার পেশা। তার প্রতারণার শিকার হয়ে লাখ লাখ টাকা খুইয়েছেন অসংখ্য মানুষ। যার অভিযোগ  পেয়েছে পুলিশ। এমনই সর্বশেষ কয়েকদিন আগে প্রতারণার শিকার হয়েছেন রাজবাড়ীর সুলতানপুর গ্রামের আবদুল বারেক সরদার। এক সন্ধ্যায় ইছহাক ফকির হাজির হয় বারেকের বাসার সামনে। বাঁশঝাড়ের কাছে তিনি একটি বস্তা পেতে বসে পড়েন। খবর শুনে বারেক সরদার বাসার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসেন। এসে দেখতে পান, চোখ বন্ধ করে বাঁশঝাড়ের সামনে বসে ধ্যান করছে ইছহাক। বারেকের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকায় ইছহাক। বারেককে ইশারায় সামনে বসতে বলে। বারেক তার সামনে বসে। ইছহাক ফকির তার মাথা ধরে আরও কাছে টেনে আনে। কানের সামনে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলে, ‘তোর বাসায় গুপ্তধন আছে। সোনার কলস। দুটা। তুই পাবি। আমার ক্ষমতা নাই তোর এখানে আসার। আমাকে পাঠানো হইছে। তোকে গুপ্তধন দিতে বলছে। তা দিতে আমি ছুটে আসছি বাজান। শুধু তোর জন্য।’ এমন কথা শুনে বারেক অবাক হয়। বলে কী লোকটা! ভাবে বারেক, পাগল তো, তাই প্রলাপ বকছে। আবার তার মন এও বলছে, হতেও পারে। সোনার কলসের গল্প তো আগে বহু শুনেছি। এমন ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পড়ে। ইছহাক ফকির এবার কথা শুরু করে। বলে, ‘শোন বাজান, প্রায় ২ কোটি টাকার সম্পত্তি। এই কলস উঠাতে হলে ভোগ দিতে হবে। মানে টাকা লাগবে।’ তার কথায় ফাঁদে পড়ে যায় বারেক। সেই সন্ধ্যায়ই বাসা থেকে ৩২ হাজার টাকা এনে তুলে দেন তিনি। এরপর ৮ মাস ধরে ২০ লাখ টাকা দেন ইছহাককে। সোনার কলসের কথা তিন কান করে পাশের গ্রামের বজলু নামের এক লোক মারা গেছেন বলেও ভয়  দেখিয়েছিলেন ইছহাক। এ জন্য এ কথা কাউকে বলেননি বারেক। নীরবে নিভৃতে টাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন বারেক। এক পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। বিষয়টি তিনি স্থানীয়দের বলে দেন। তারা পাকড়াও করে ইছহাক ফকিরকে। এ সময়  সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সোনালি রঙের জরি মাখানো মাটির দলাসহ কথিত সোনার কলসের নামে পিতলের দুটি খালি কলস। পরে তাকে পুুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। দীর্ঘদিন ধরেই ইছহাক ফকির সোনার কলসের কথা বলে মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, ফরিদপুরের এ ঘটনাটি এখন সারা দেশের চিত্র। বিভিন্ন জেলায় ইছহাক ফকিরের মতো লোকজন আস্তানা গেড়ে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলছে। তাদের খপ্পরে পড়ে সহায় সম্পদ হারিয়ে অনেকেই পথের ফকির। মানুষের অসচেতনতার কারণে নিজেরাই ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে সহজ সরল মানুষ। এমন আস্তানার খবর পাওয়া মাত্র পুলিশকে জানাতে হবে বলে মনে করেন তারা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর