শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ছোট ভুল বড় ক্ষতি

মির্জা মেহেদী তমাল

ছোট ভুল বড় ক্ষতি

বাপ্পীকে অপহরণ করা হয়েছে- ফোনে এমন খবর শুনে আলফু মিয়া নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে দ্রুত বেরিয়ে পড়েন। কোতোয়ালির ১ নম্বর বেচারাম দেউরির বাসায় ঢুকেই এ ঘর-ও ঘর ছোটাছুটি করেন। চিৎকার করে ছেলেকে ডাকতে থাকেন। ‘লাল, ও লাল! আমার লাল কই?’ স্ত্রী রোকসানা বেগম বলেন, ‘কেন, ও তো মাঠে খেলতেছে।’ আলফু মিয়া মাঠে ছোটেন। পেছন পেছন রোকসানা বেগম। তারা বাপ্পীর বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করেন। না, আসেনি বাপ্পী খেলতে, জানায় বাপ্পীর বন্ধুরা। এবার আলফু মিয়া যেন চোখে অন্ধকার দেখছেন। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। তবে কি, সত্যি সত্যি অপহরণ করেছে তার কলিজার টুকরোকে! স্ত্রীকে সেই ফোনকলের কথা জানান। স্ত্রী রোকসানা পুলিশকে জানাতে বলেন। কিন্তু আলফু মিয়া ভয় পান। অপহরণকারীরা তাকে পুলিশে খবর দিতে নিষেধ করেছে। পুলিশ জানতে পারলে বাপ্পীকে আর ফেরত পাবে না বলে হুমকি দিয়েছে। দিশাহারা আলফু মিয়া কী করবেন, বুঝতে পারেন না। তার ভায়রার ছেলে শিপনকে ফোন দেন আলফু মিয়া। বলেন, ‘শিপন, বাবা তুমি কোথায়? বাপ্পীর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। তুমি আসো বাবা।’ এমন খবর শুনেই ছুটে আসে শিপন। শিপন এসে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে, ‘বাপ্পীরে কারা নিল খালু! হায় হায়।’ শিপনকে খুব পছন্দ করত বাপ্পী। শিপন বলতে থাকে, ‘আজকে আমারে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে খাওয়াল বাপ্পী।’ এসব কথা বলেই আবার সান্ত¡না দেয় শিপন। ছেলেকে ফেরত পেতে পাগলপ্রায় আলফু মিয়া ২০ লাখ টাকা জোগাড় করে অপেক্ষায় থাকেন। তিনি বার বার পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করেন, আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখেন। পরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলেও তিনি কেটে দিচ্ছেন। সন্ধ্যা ৭টায় অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। দ্রুত রিসিভ করেই হ্যালো বলেন আলফু মিয়া। অন্য প্রান্ত থেকে যা বলা হচ্ছে, তিনি তা কলম দিয়ে টুকে নিচ্ছেন। বলছেন, ‘ঠিক আছে ভাই। পুরো টাকা রেডি আছে। আমি একাই আসব রাত ৮টার মধ্যে। না না ভাই, কেউ জানবে না। পুলিশকে বলব না ভাই। রাত ৮টার মধ্যে আমি ডেমরার ছনপাড়া বস্তির সামনে এসে দাঁড়াব টাকা নিয়ে। ভাই আমার পোলাডা ভালো আছে তো?’ অন্য প্রান্ত থেকে কোনো জবাব পান না। লাইন কেটে যায়। টাকা নিয়ে ছুটে চলেন আলফু মিয়া। যেভাবেই হোক রাত ৮টার মধ্যে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু পথে জ্যামে আটকে যান তিনি। গাড়ি আর এগোয় না। গাড়ি থেকে নেমে যান। দৌড়াতে থাকেন। আরেকটা গাড়িতে চড়েন। ছুটতে থাকেন। কিন্তু রাত ৮টার মধ্যে পৌঁছাতে পারেননি আলফু মিয়া। রাত ৯টায় সেখানে পৌঁছে অপহরণকারী কারও দেখা পান না। সন্ধান পান না তার সন্তানের। বাসায় ফেরত যান। পুলিশের শরণাপন্ন হন। পুলিশের অভিযান শুরু হয়। পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে হানা দেয় পুলিশ। তিন দিন পর গ্রেফতার হয় অপহরণকারী ঘাতক চক্র। এর পরের গল্প নির্মমতার। ডেমরা থেকে গ্রেফতার করা হয় ঘাতক চক্রের সদস্য শংকরকে। শংকরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে পুলিশ কিছুটা হোঁচট খায়। অপহরণের পুরো ঘটনার মোড় ঘুরে যায়। পুলিশের কাছে স্বীকার করে কীভাবে বাপ্পীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। কার পরিকল্পনায় খুনের ঘটনা ঘটে তাও ফাঁস করে শংকর। পুলিশ পুরো ঘটনার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর আলফু মিয়াকে পুলিশ জানায় পুরো ঘটনাটি। পুলিশ জানায়, তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ এবং বাপ্পীর পছন্দের খালাতো ভাই শিপন হলো এ অপহরণ ও খুনের নেপথ্য কারিগর। তার নেতৃত্বেই অপহরণ ও খুনের ঘটনা ঘটে। এ কথা শুনে হতবাক পরিবারের সদস্যরা। পুলিশ খোঁজ করতে থাকে শিপনসহ খুনে জড়িত তাদের বন্ধু রিপন ও জাহিদকে। তারা পুলিশের কাছে খুনের বর্ণনা করে। তারা পুলিশকে জানায়, ২০ লাখ টাকা নিয়ে ডেমরায় যেতে বলা হয় আলফু মিয়াকে। আলফু মিয়ার দেরি হওয়ায় তাদের সন্দেহ হচ্ছিল পুলিশকে জানানো হয়েছে। পুলিশ জানতে পারলে শিপনের বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাবে। যে কারণে তড়িঘড়ি করে বাপ্পীকে হত্যা করা হয়। ঘাতক শংকরের ভাষায়, ‘নদীতে ঘোরানোর কথা বলে শিপন তার খালাতো ভাই বাপ্পীকে নৌকায় তুলে নেয়। বাপ্পীর সঙ্গে শিপনের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। বাপ্পী একটু পরপর শিপন ভাইয়া শিপন ভাইয়া বলে বিভিন্ন প্রশ্ন রাখত। জানতে চাইত। নৌকায় তোলার পর চানাচুর আর বিস্কুট খাওয়ানো হয়। শিপনের কোলে মাথা রাখতে খুব ভালো লাগছিল বাপ্পীর। তাই কোলে মাথা রেখেই আকাশ দেখছিল। তখন রাত ১২টা হবে। একসময় বাপ্পী ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত বাপ্পীর চেহারা দেখে আমাদের মায়া হচ্ছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তাকে খুন করব না। কিন্তু শিপন তাতে রাজি হয়নি। ঘটনা ফাঁস হয়ে যাবে বলে খুনের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। একসময় শিপন গলা চেপে ধরে আর আমি দুই পা চেপে ধরি। বাপ্পীর শরীর থেকে কাপড় খুলে শীতলক্ষ্যা নদীর কাটপট্টি এলাকায় ছুড়ে ফেলে দিই। এর পরই আমরা দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি।’

আপন খালাতো ভাইকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করার মতো ঘটনাটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাপ্পীর বাবা-মায়ের ছোট ভুলে চরম ভাবে খেসারত দিতে হয়েছে। অপহরণের পরপর পুলিশকে খবর দেওয়া গেলে হয়তো বাপ্পীকে প্রাণেও রক্ষা করা যেত। দ্রুততার সঙ্গে পুলিশ যেভাবে খুনি চক্রকে গ্রেফতার করেছে, একইভাবে বাপ্পীকেও উদ্ধার করা যেত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর