শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

পশ্চিমবঙ্গের ভোটবাজার চার প্রশ্নে সরগরম

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

পশ্চিমবঙ্গের ভোটবাজার চার প্রশ্নে সরগরম

নির্বাচনের ইতিহাসে এবারই প্রথম জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি), নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, অনুপ্রবেশ ও সংখ্যালঘু তোষণ নীতি- এই চারটি প্রশ্নে নির্বাচনী প্রচারণার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা ভালো এই ইস্যুতেই সরগরম হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গে ভোটের বাজারের রাজনীতি। এই বিষয়গুলোকে এ রাজ্যে ভোট জয়ের জন্য প্রধান হাতিয়ার করেছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই ভোটের ময়দানে এই বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে দলের সভাপতি অমিত শাহসহ ছোট বড় সব নেতাই। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে গৃহস্থের হেঁশেল সর্বত্রই এই চার প্রশ্নে চলছে বিতর্ক আর মতবিনিময়।

এরই সঙ্গে রয়েছে কর্মসংস্থান, দুর্নীতি, পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অভিযান এবং কেন্দ্রে আগামী সরকার গঠনে তৃণমূলের ভূমিকার মতো ইস্যুগুলোও। আর বিজেপির এই প্রশ্নের মুখে পড়ে পাল্টা জবাব দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসও। বৃহস্পতিবার গোটা ভারতের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট হয়েছে। এই দফায় রাজ্যে ৪২টি আসনের মধ্যে প্রথম দফায় মাত্র ২টি আসনে ভোট হয়েছে, বাকি এখনো ৪০টি আসন। কিন্তু দিন যত এগোচ্ছে ততই নিজেদের মধ্যে বাগ্যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে বিজেপি ও তৃণমূল। বৃহস্পতিবারই অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জে এক জনসভায় বলেন, ‘ক্ষমতায় এলে আসামের মতো এ রাজ্যেও নাগরিকপঞ্জি হবেই। অনুপ্রবেশকারীদের এক একজনকে চিহ্নিত করে তাদের সাগরে ফেলে দেওয়া হবে। মমতাজি সব শক্তি দিয়ে বাধা দিলেও এনআরসি ঠেকাতে পারবেন না।’ গত সপ্তাহে শিলিগুড়ি, কোচবিহারের জনসভায়ও অমিত শাহ অনুপ্রবেশ, এনআরসি, নাগরিকত্ব বিলকে আঁকড়ে ধরে ভোটের মাঠ গরম করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, অনুপ্রবেশকারীদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে এবং বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। অনুপ্রবেশকারীরা মমতার ভোট ব্যাংক বলেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি মোদি।

মমতাও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন কোনো মতেই এ রাজ্যে এনআরসি চালু করতে দেব না। তার পাল্টা চ্যালেঞ্জ ‘বাংলার গায়ে হাত দিয়ে দেখুক, মজা বুঝতে পারবে।’

২০১৮ সালের ৩০ জুলাই আসামে প্রকাশিত হয় এনআরসির চূড়ান্ত খসড়া তালিকা। কিন্তু সেই তালিকা থেকে ৪০ লাখ নাগরিকের নাম বাদ পড়ার পরই বিতর্ক তৈরি হয়। মমতার দাবি এনআরসির নামে বাঙালি ও মুসলিম খেদাও চলছে। আর নাগরিকত্ব বিলের ফলে প্রকৃত ভারতীয়রাই বিদেশি নাগরিকে পরিণত হবে। বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক কৈলাশ বিজয়বর্গীয় জানান, ‘রাজ্য থেকে মমতার অপশাসন এবং তৃণমূলের সরকারকে উপড়ে ফেলতে দুর্নীতি, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এ রাজ্যে এনআরসি চালু করা, অনুপ্রবেশ ইস্যুগুলোকেই আমাদের প্রচারণার তালিকায় রেখেছি।’ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বিস্তৃত আছে ৪০৯৬ কিলোমিটার, এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে দীর্ঘ ২২১৬.৭ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। দেশ ভাগের সময় থেকেই অনুপ্রবেশ ও উদ্বাস্তু সমস্যায় জর্জরিত এই রাজ্য। স্বাভাবিকভাবেই এনআরসি, নাগরিকত্ব বিল ও অনুপ্রবেশ-এই তিন ইস্যুতে রাজ্যটির একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে। যদিও তৃণমূলের মহাসচিব ও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি বলেন, ‘এনআরসি এবং নাগরিকত্ব বিল সাধারণ মানুষের কতখানি ক্ষতি করবে এবং বিজেপি কীভাবে তাদের ভুল পথে পরিচালিত করছে-আমরা সেটা মানুষের কাছে গিয়ে সেই বার্তা দিচ্ছি। এতে আমরা ভালো সাড়া পাচ্ছি আসলে কেউই আর উদ্বাস্তু হতে চায় না।’

অনুপ্রবেশ ইস্যু ভারতের অর্থনীতি বা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কতটা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্বাচনী প্রচারণায় তাও তুলে ধরছে গেরুয়া শিবিরের নেতারা। তাদের অভিযোগ সংখ্যালঘু তোষণনীতির কারণেই তৃণমূল অনুপ্রবেশে মদদ দিচ্ছে।  পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। আর এই সংখ্যালঘু ভোটই রাজ্যের যে কোনো নির্বাচনে বড় ফারাক গড়ে দেয়। রাজ্যটির ১২ থেকে ১৪টি লোকসভা আসন এলাকায় এরাই নির্ণায়ক শক্তি। যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জ, কোবচিহার, বালুরঘাট, মালদা উত্তর, মালদা দক্ষিণ, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ি, জয়নগর, বসিরহাট, বনগাঁ। ফলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই লক্ষ্য থাকে ওই ভোট নিজেদের কাছে টানা। একটা সময় এই ভোটকে কাজে লাগিয়ে বাজিমাত করেছিল বামেরা। আর ২০১১ সালে রাজ্যে পালা বদলের নির্বাচনের সময় থেকে সংখ্যালঘুদের একটা বড় অংশ মমতা ব্যানার্জির তৃণমূলের পাশে থেকেছে। এ ব্যাপারে তৃণমূলের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানান, ‘বিজেপি এ রাজ্যে মুসলিমদের টার্গেট করছে। কিন্তু আমরা তা কিছুতেই হতে দেব না।’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে অবৈধ মাদ্রাসাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং কোনোরকম তোষণ নীতিকে বরদাশত করা হবে না।’ তিনি বলেন, ‘তৃণমূল দুর্নীতির সরকার চালাচ্ছে। আমরা পাশ্চিমবঙ্গে এর আগে এত পরিমাণ দুর্নীতি কখনো দেখিনি।’ তবে রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে এর সবটাই হচ্ছে ভোট রাজনীতির কথা মাথায় রেখেই। কারণ ভোট এলেই ধর্ম বা সম্প্রদায় ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে ভোট বৈতরণী পেরোতে চায় রাজনৈতিক দলগুলো।

সর্বশেষ খবর