শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

মুখোশে ঢাকা মুখ

মির্জা মেহেদী তমাল

মুখোশে ঢাকা মুখ

পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা বাচ্চাটাকে রাতে যখন ইমারজেন্সি ওটিতে ঢুকানো হয় তখন বাজে ৩টা। ব্যথা ও আতঙ্কে বাচ্চা ছেলেটা অঝোর ধারায় কাঁদছিল। ওর ফাইলটা হাতে নেন চিকিৎসক। অবাক বিস্ময়ে তার এক্সরে ফিল্মগুলোতে তাকিয়ে আছেন। ১০ বছর বয়সী ছেলেটার পায়ের তিন জায়গায় ভাঙা! বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সে একটু আশ্বস্ত হলো। ভীতসন্ত্রস্ত চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে সে।

চিকিৎসকের মায়া লাগছে বাচ্চাটিকে দেখে। মাস্কটা খুলে ভীত ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নাম কি তোমার বাবা? উত্তর এলো- ‘মাসুম’। কীভাবে এক্সিডেন্ট করলে? ‘ছাদ থেইকা পইড়া গেছিলাম।’ পাশ থেকে এক ওটি বয় বলল, ‘স্যার মাদ্রাসা থেকে পালাতে গিয়ে ওর এই হাল!’ মাসুম ক্ষীণ কণ্ঠে প্রতিবাদ করল। ওর কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা শুনতে চাইলেন চিকিৎসক। বাচ্চাটি বলতে থাকে- ‘আমার নাম মাসুম, বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আমরা দুই ভাই দুই বোন। আমার ভাই এবার এসএসসি দিছে। বোনেরা স্কুলে পড়ে। আমার আব্বা বিদেশ থাকে। বেশি দুষ্টামি করতাম বলে মা আমারে পাঁচ দিন আগে মাদ্রাসায় ভর্তি করাইয়া দেন। আমি আমার মাকে ছাড়া এক দিনও থাকতে পারি না। মাদ্রাসায় বইসা কানতাম আর বাড়ি চইলা যাইতে চাইতাম। বাড়ি যাইতে চাইতাম বইলা হুজুর আমারে শিকল দিয়ে বাইন্ধা রাখছে টানা চার দিন। বেল্ট আর লাঠি দিয়ে মারছে। পিঠে ব্যাথা। দাগ আছে। হুজুরে বলছে, মায়ের কাছে এসব বললে, একেবারে মাইরা ফালাবে। ৪ দিন পর হুজুররে বলছি আমি এখানেই থাকমু, আমারে আর মাইরেন না, শিকল খুইলা দেন। শিকল খোলার পরের দিন আমি মাদ্রাসার ছাদে উইঠা পাশের বাড়ির ছাদ দিয়ে পালাইতে যাই। আমারে হুজুর দেইখা ফালায়। হুংকার দিয়া কয় এখুনি নাম, তা না হইলে তোরে মাইরা ফালামু। আমি ভয় পাইয়া নামতে গিয়া ৩ তলা থেইকা মাটিতে পইড়া যাই। স্যার আমার পা ঠিক করতে পারবেন তো?’ হেসে চিকিৎসক বলছিলেন, ‘হুম, ঠিক করে দেব।’ ‘না স্যার, আমি আর দুষ্টামি করমু না। আমার মারে আপনি একটু বলে দিয়েন। আর ওই হুজুরের যেন বিচার হয় সেই ব্যবস্থা কইরেন।’ এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা। মাদ্রাসার ছোট হুজুরকে না বলে বাইরে গিয়েছিল ইয়াছিন হাওলাদার (১০)। এতে শিশু শিক্ষার্থীকে দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে জোড়া বেত দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। গত ৩০ মার্চ দিবাগত রাতে খুলনার ফুলতলার মুক্তিশ্বরীর হযরত বুড়ো ফকিরিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায় এ ঘটনা ঘটে। বেত্রাঘাতে যন্ত্রণাকাতর শিশু ইয়াছিনকে রাত ১টায় ফুলতলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে এলাকাবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়লেও ছোট হুজুর সেলিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে গত সপ্তাহে ৮ বছরের শিশু মনিরুল ইসলামকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এর আগে তার বাবার কাছে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণও দাবি করে অপহরণকারীরা। হত্যার অভিযোগে মসজিদের ইমামসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত সোমবার ঢাকা ডেমরার বাঁশেরপুল ডগাইর এলাকার মসজিদুল-ই-আয়েশা নামে একটি মসজিদ থেকে ওই শিশুর বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের ডিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, শিশু মনিরুল ডগাইর এলাকার নূরে আয়েশা সিদ্দিকিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। সে ডেমরার ডগাইর নতুনপাড়া এলাকার শামসু মিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া সাইদুল হকের ছেলে। তাদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বিটগর গ্রামে। ওই মাদ্রাসার মসজিদের নাম মসজিদুল-ই-আয়েশা। এর ইমাম আবদুল জলিল হাদী শিশুটির বাবা সাইদুলের পূর্ব পরিচিত। সাইদুল বাচ্চাদের স্কুল ব্যাগ তৈরি করে চকবাজারে নিয়ে বিক্রি করতেন। এ ব্যবসায় তিনি আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তার কাছ থেকে টাকা-পয়সা ধার নিত হাদী। ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সাইদুলের নগদ টাকার প্রতি লোভে পড়ে তার ছেলে মনিরুলকে অপহরণের পরিকল্পনা করে হাদী। গত রবিবার মাদ্রাসা ছুটির পর বেলা ১১টার দিকে মনিরুলকে অপহরণ করে আবদুল জলিল হাদী এবং দুই ছাত্র আহাম্মদ সফি তোহা ও আকরাম। এরপর তাকে মাদ্রাসা মসজিদে নিয়ে যায়। সেখানে নেওয়ার পর মসজিদের সিঁড়িতে মনির কান্না শুরু করে। তখন অপহরণকারীদের একজন তার মুখ চেপে ধরে। এতে সে আরও জোরে চিৎকার শুরু করে। তখন হাদীর গামছা দিয়ে মনিরের চোখ-মুখ বেঁধে ফেলা হয়। একপর্যায়ে সে মারা যায়। পরে তার লাশ সিমেন্টের একটি বস্তায় ভরে সিঁড়ির পাশে রেখে দেয় তারা। এরপর মনিরের বাবা সাইদুল হকের কাছে রাতে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তোহা। ওই টাকা ওই মসজিদের লাশ রাখার খাটিয়ার নিচে রেখে আসতে বলা হয়। টাকা নিয়ে মসজিদে যাওয়ার পরও ছেলেকে ফিরে না পেয়ে বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করেন সাইদুল। পরে সোমবার বিকালে মসজিদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার সিঁড়ির মাঝখান থেকে শিশু মনিরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এ ধরনের ঘটনা এখন ঘটছে সারা দেশে। সোনাগাজীর নুসরাতের হত্যাকা  নিয়ে দেশ এখন তোলপাড়। শিক্ষকের মুখোশে ঢাকা পাষ রা নানাভাবে শিশু নির্যাতন থেকে শুরু করে হত্যাকা  ঘটিয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে বিচারহীনতাকেই দোষারোপ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, শিশুদের যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই দেওয়া হোক না কেন, সেই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বাবা-মায়ের খোঁজখবর নিতে হবে। তাছাড়া ভর্তি করিয়েই সব শেষ নয়। মাঝে-মধ্যে অবশ্যই সন্তানদের খোঁজখবর নিতে প্রতিষ্ঠানে যেতে হবে। অন্যথায় এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা বন্ধ হবে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর