রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

পণ্যের শুল্কমুক্তি নিয়ে ঐকমত্য

শেখ হাসিনা-ডা. শেরিং বৈঠকে বাংলাদেশ-ভুটান পাঁচ চুক্তি সই

নিজস্ব প্রতিবেদক

পণ্যের শুল্কমুক্তি নিয়ে ঐকমত্য

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. শেরিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বৈঠক করেন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংয়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ঢাকা-থিম্পু পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার নিয়ে কাজ করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। বৈঠক শেষে স্বাস্থ্য, কৃষি, নৌপরিবহন (জাহাজ চলাচল), পর্যটন খাতে সহযোগিতা এবং জনপ্রশাসন খাতে প্রশিক্ষণসহ পাঁচটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছে। ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গতকাল দুই পক্ষের মধ্যে এ বৈঠক হয়। লোটে শেরিং সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে তাঁকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে ৩০ সদস্য নিয়ে সফরে আসা ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা। 

বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রথম স্বীকৃতিদাতা দেশ ভুটান। শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং।

ঐকমত্য : বাংলাদেশ ও ভুটান পারস্পরিক স্বার্থে তাদের দেশীয় বাজারে উভয় দেশের বেশ কিছু পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে ঐকমত্য প্রকাশ করে। বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশ এবং ভুটানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় ভুটান বাংলাদেশের বাজারে দেশটির ১৬টি পণ্যের শুল্ক এবং কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার চেয়েছে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা ১০টি পণ্যে কোটা ও শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়েছি। ভুটান ডব্লিউটিওর সদস্য না হওয়ায় তাদের নিজস্ব কিছু প্রথা আছে। তাই কোটামুক্ত, শুল্কমুক্ত প্রশ্ন উঠছে। তাদের বেশ কিছু জিনিসে কোটা ও শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়েছে। আমরা ধরে নিতে পারি যে, কোটা ও শুল্কমুক্ত সুবিধার বিষয়ে নীতিগত সম্মতি হয়েছে। শহীদুল হক বলেন, দ্বিপক্ষীয় আলোচনাটি খুবই ইতিবাচক হয়েছে এবং আলোচ্য বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হওয়ায় এগুলো কার্যকর হবে বলেও আশা করা যায়। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বলেছেন, আমরা মনে করি, দুই দেশই এটি কার্যকরের বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। এখন এটি বাস্তবায়ন পর্যায়ে কাজ করতে হবে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং স্বাস্থ্য খাতের বিষয়ে আলোচনায় প্রাধান্য দেওয়া হয়। আঞ্চলিক কানেকটিভিটি বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, ট্রানজিটের ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের উদ্যোগ এ অঞ্চলে আছে। বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া, নেপাল) সড়ক ও রেল কানেকটিভিটির চুক্তিতে। সব রাষ্ট্র সই করেছে। কিন্তু এটা অনুস্বাক্ষরের বিষয়ে ভুটান তাদের পার্লামেন্টে পাঠাতে পারেনি। এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা। বিবিআইএন নিয়ে লোটে শেরিংয়ের নেতৃত্বাধীন ভুটানের নতুন সরকার ইতিবাচক জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, তারা এ বিষয়টি আলোচনার জন্য আপার সিনেটে নিয়ে আসবে। তারা খুবই আশাবাদী।

 

সম্পর্কের গভীরতা আরও বাড়ছে : ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক আরও বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটানের সম্পর্কই যে গভীরই হচ্ছে তা নয়, এর ব্যাপ্তিটাও বাড়ছে। ব্যবসা ক্ষেত্রেও ব্যাপ্তি বাড়ছে। শহীদুল হক বলেন, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফরের পর বাণিজ্য বেড়েছে এবং মানুষে মানুষেও সম্পর্ক বাড়ছে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে ভুটানে সবচেয়ে বেশি পর্যটক গেছে। ভুটান থেকেও আসছে। বৈঠকে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলের অটিজম নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং এর জন্য মানবকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিতে আগ্রহ : পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ভুটান সরকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেওয়ার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি এ ব্যাপারে ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে দেখবেন, বাংলাদেশের কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যদি নিয়মিত নাও হন তাহলে অন্তত কিছু দিনের জন্য প্র্যাকটিস করে আসা যায় কিনা! শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশে সার্ক স্কলারশিপের আওতায় মেডিকেল এবং প্রকৌশল বিভাগে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে। মেডিকেল ও নার্সিং মিলে এখন প্রতিবছর ১০ জন করে সুযোগ পায়। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দুই দেশের বৈঠকের সূত্র ধরে সেটাকে ১৫ জনে উন্নীত করা হয়েছে।

পাঁচটি চুক্তি স্বাক্ষর : স্বাস্থ্য, কৃষি, জাহাজ চলাচল, পর্যটন ও জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ বিষয়ে সহযোগিতা জোরদারে ঢাকা ও থিম্পু গতকাল পাঁচটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনার পরে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সফররত ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং চুক্তি স্বাক্ষরের সময় উপস্থিত ছিলেন। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে পরিবহন এবং ট্রানজিট কার্গো চলাচলে অভ্যন্তরীণ জলপথ ব্যবহারের বিষয়ে দি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। নৌ পরিবহন সচিব আবদুস সামাদ এবং ভুটানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব দাশো ইয়েসি ভাংদি এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশের স¦াস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং রাজকীয় ভুটান সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা চুক্তিতে (এমওইউ) স্বাক্ষর করেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম এবং ভুটানের স্বাস্থ্য সচিব উগানদা দফু।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) এবং ভুটানের কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি বিভাগের মধ্যে সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বিএআরসির নির্বাহী পরিচালক কবির ইকরামুল হক ও ঢাকায় ভুটানের রাষ্ট্রদূত সোনম তোপদেন রাবগি।

বাংলাদেশ জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি) এবং ভুটানের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের (আরআইএম) মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বিপিএটিসির রেক্টর ড. এম আসলাম আলম এবং ভুটানের রাষ্ট্রদূত সোনম তোপদেন রাবগি। পাশাপাশি, দুই দেশের মধ্যে পর্যটন খাতে সহযোগিতা বিষয়ে ভুটানের পর্যটন কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন একটি সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান খান কবির এবং ভুটানের রাষ্ট্রদূত সোনম তোপদেন রাবগি নিজ নিজ পক্ষে সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সাড়ে ১১টার দিকে বের হয়ে হোটেলে যান ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং। এর পর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালিক ও নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হোটেল কক্ষে পৃথক সাক্ষাৎ  করেন। পরে সন্ধ্যায় ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাতে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সম্মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আয়োজিত নৈশভোজে যোগদান করেন।  গত শুক্রবার ঢাকায় পৌঁছেই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ও জাতীয় সৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান ভুটানের প্রধানমন্ত্রী। পরে বিকালে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে মতবিনিময় করেন। আজ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সুরের ধারা আয়োজিত বর্ষবরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। বিকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং সেখানকার পুনর্মিলনীতে যোগ দেবেন এবং ভাষণ দেবেন। বিকালেই রাজধানীতে ফেরার পর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এ ছাড়া সফরকালীন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বিমসটেক সচিবালয় ও বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জনস পরিদর্শন করবেন। তিন দিনের সফর শেষ করে আগামীকাল তার ঢাকা ত্যাগ করার কথা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এটাই কোনো সরকারপ্রধানের প্রথম সফর। শুক্রবার ঢাকায় পৌঁছালে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অষ্টাদশ ব্যাচের ছাত্র লোটে শেরিং এমবিবিএস পাস করার পর বাংলাদেশেই সার্জারিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। দেশে ফিরে যোগ দেন চিকিৎসকের পেশায়। সরকারি চাকরি ছেড়ে ২০১৩ সালে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই তার দল ডিএনটি চমক সৃষ্টি করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ডিএনটি জয়ী হলে ডা. শেরিং হন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর