শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

হরেক অপরাধের ভয়ঙ্কর চক্র

মির্জা মেহেদী তমাল

হরেক অপরাধের ভয়ঙ্কর চক্র

ফেসবুকে পরিচয়। এরপর আলাপ। ভালো লাগা। প্রেম। রায়হান-কাজলের সময় কাটছিল বেশ। কিন্তু প্রেমিকা কাজলের যেন আর তর সইছিল না। রায়হানকে বলেন, ‘আসো আমরা দেখা করি একদিন’। এমন একটি প্রস্তাবের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলেন রায়হান। প্রস্তাব পেয়ে তিনি এক কথাতেই রাজি। দেখা করবেন রায়হান। রাজধানীর কলাবাগানের বাসিন্দা রায়হান তার প্রেমিকা কাজলের বাসা আমিনবাজারে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। গত ১২ এপ্রিল রাতে বাসা থেকে বেরিয়ে যান রায়হান। খবর দেন তার পরিচিত গাড়িচালক বাহারকে। বাহার ভাড়ায় গাড়ি চালান। সাধারণত তিনি রেলস্টেশন বিমানবন্দর ও বাস টার্মিনাল থেকে যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে যান। ফোন দেওয়া মাত্রই রায়হানের কাছে হাজির হয়ে যান পূর্বপরিচিত বাহার। বাহারের গাড়িতে করে আমিনবাজারের উদ্দেশে রওনা হন রায়হান। ঠিকানা মতে আমিনবাজার যাওয়ার পর বাহারের    ভিন্ন রকম ব্যবহারে হতবাক রায়হান। তার প্রেমিকা কাজলের দেখা পান। কিন্তু কাজলকে দেখেও রায়হান ভয় পান। কারণ তারা প্রত্যেকেই রায়হানের হাত-পা বাঁধতে শুরু করেছেন। রায়হানের বুঝতে আর বাকি থাকে না কিছু। তিনি বুঝতে পারেন, এতদিন যে মেয়েটির প্রতি তিনি দুর্বল হয়েছিলেন, তিনি আসলে অপহরণকারী চক্রের সদস্য। শুধু তাই নয়, গাড়িচালক বাহারও একই চক্রের। বাহার তাকে দীর্ঘদিন ধরেই অনুসরণ করছিলেন অপহরণ করার জন্য। কাজলকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চক্রের সেই আস্তানায় ছিল আরও বেশ কয়েকজন। রায়হানের হাত-পা বেঁধে মারধর করতে থাকে তারা। এরপর রায়হানের বাসায় ফোন করেন বাহার। ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। দেনদরবার করে অবশেষে অপহরণকারীরা ৫ লাখ টাকায় রাজি হয়। গত ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় মিরপুর মডেল থানা এলাকার ষাটফিট ভাঙা ব্রিজের পাশে একটি পরিত্যক্ত সিগারেটের বাক্সের পাশে কাগজ দিয়ে টাকা পেঁচিয়ে রাখতে বলেন বাহার। সেই সন্ধ্যায় রায়হানের পরিবার পরিকল্পনা মতো ১ লাখ টাকা দিয়ে আসে। কিন্তু অপহরণকারীরা সেই টাকা নিয়ে যাওয়ার পর বাকি টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। অন্যথায় রায়হানের লাশ পড়বে বলে হুমকি দিতে থাকে। এরই মধ্যে বিষয়টি র‌্যাবকে জানানো হয়। র‌্যাব তদন্ত শুরু করে। গত বুধবার রাতে অভিযান চালিয়ে সাভারের আমিনবাজার থেকে কথিত প্রেমিকাসহ অপহরণ চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৪। অপহরণ চক্রের সদস্যরা হলেন- আজিজুল হাকিম (৪০), লিটন মোল্লা (২৬), কাজল বেগম (২৬), নজরুল ইসলাম বাবু (৪২), নুরু মিয়া মোল্লা (৬২)। উদ্ধার করে রায়হানকে।

র‌্যাব জানায়, গেফতার নুরু মিয়া মোল্লা (৬২) ও কাজল বেগম (২৬) বাবা-মেয়ে পরিচয়ে বাসা ভাড়া নেন। ভাড়া বাসাতেই তারা অপহরণ করে নিয়ে এসে নির্যাতন ও মুক্তিপণ দাবি করতেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টের পাওয়ার ভয়ে এক মাস কিংবা দুই মাস পরপর তারা বাসা পরিবর্তন করে ফেলতেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অপহরণকারীরা জানায়, তারা ১০ বছর ধরে ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও চাকরিজীবী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন ও কৌশলে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে আসছেন।

র‌্যাব গতকাল জানায়, ঢাকাসহ আশপাশের বাস স্টেশন থেকে যাত্রীদের চাহিদা মতো স্থানে যাওয়ার কথা বলে মাইক্রো বা প্রাইভেট কারে উঠিয়ে নেন বাহার। তার গাড়িতে যাত্রীবেশে আগে থেকে অবস্থান করা ৩/৪ জন ব্যক্তি গাড়ি চলা অবস্থায় সাধারণ যাত্রীকে অজ্ঞান করে অথবা হাত-পা ও মুখ বেঁধে তাদের এলাকায় নিয়ে যায়। আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করে। এই একই চক্র সুন্দরী মেয়ে দিয়ে ফেসবুকের ফেক আইডির মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও চাকরিজীবীদের টার্গেট করে তার সঙ্গে বন্ধুত্বের মাধ্যমে মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে। একপর্যায়ে দেখা করার বায়না করে অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা তাদের পূর্বপরিকল্পিত এলাকায় নিয়ে আসে এবং ভিকটিমকে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করে ভিকটিমের পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করে।

সর্বশেষ খবর