শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

সর্বোচ্চ সতর্কতায় বাংলাদেশ

পুলিশ সদর দফতর থেকে বিশেষ বার্তা, নির্দেশনা র‌্যাবের সব ব্যাটালিয়নকে, ব্যাপক নিরাপত্তা

সাখাওয়াত কাওসার

শ্রীলঙ্কার গির্জা ও অভিজাত হোটেলে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনার পর থেকে সতর্ক বাংলাদেশ। সব ধরনের সম্ভাবনা মাথায় রেখেই নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রস্তুতি। পুলিশ সদর দফতর থেকে দেশের সব কটি রেঞ্জ, মহানগর পুলিশ, জেলায় পাঠানো হয়েছে বিশেষ বার্তা। র‌্যাব সদর দফতরও সতর্ক করেছে তাদের সব কটি ব্যাটালিয়নকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে সিরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে তথাকথিত জঙ্গি কর্মকা-ে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা যাতে দেশে ফিরতে না পারে এমন একটি তালিকাও পাঠানো হয়েছে দেশের সব কটি বিমান, স্থল ও সমুদ্রবন্দরে।

এদিকে মে দিবস, বুদ্ধ পূর্ণিমা, রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। গতকাল ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সব পুলিশ ইউনিটকে তিনি এ নির্দেশ দেন।

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ভিডিও কনফারেন্সে আইজিপি বলেন, যে কোনো প্রকার সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কর্মকা  রোধে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অতীতে যেভাবে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস মোকাবিলা করা হয়েছে ঠিক একইভাবে জনগণের সহায়তা নিয়ে কাজ করতে হবে। পুলিশপ্রধান আরও বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মান বৃদ্ধি এবং সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশনা দেন। এ ছাড়াও নারী ও শিশুর প্রতি যে কোনো প্রকার সহিংসতার বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ পুলিশের সব ইউনিটকে নির্দেশ দেন আইজিপি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নিউজিল্যান্ডের পর শ্রীলঙ্কায় হামলার ঘটনা ঘটেছে মাত্র ৩৬ দিনের মাথায়। পাল্টাপাল্টি আরও ঘটনা ঘটবে। এ জন্য আরও সতর্কতা প্রয়োজন। গত সাড়ে তিন বছরে আমরা জঙ্গিবাদ সাফল্যের সঙ্গে দমন করতে পেরেছি এ রকম তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে কোনো রকম শিথিলতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের প্রভাব পরিমাপ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। শ্রীলঙ্কার পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগাম খবর পাওয়ার পরও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। শিথিলতা, কমিটমেন্টের অভাব এবং অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকার কারণেই এত বড় ঘটনা ঘটেছে।’ জানা গেছে, ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে এবং মাত্র ৩৬ দিনের মাথায় শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ হামলার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থাকে। তবে নিউজিল্যান্ডের ঘটনার পর থেকে অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থাপনায় জোরদার করা হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা। পোশাকে ও সাদা পোশাকে বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা নি-িদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে মন্দির ও গির্জাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ের দিকে থাকছে বিশেষ দৃষ্টি। সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে ঢাকার কূটনৈতিক এলাকাতেও। মঙ্গলবার অপরাধ প্রতিবেদকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কায় হামলার প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে পারে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে আমরা যথেষ্ট সতর্ক রয়েছি। এ দেশ থেকে কতিপয় লোক আইএসে গিয়েছে ২০১৪ সালের শেষ দিকে। এদের পাসপোর্টের মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে। সুতরাং তাদের ফিরতে হলে দূতাবাসে গিয়ে ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করতে হবে। যারা গিয়েছেন তারা ক্যাপচারড, ডিটেইন্্ড অথবা ডেথ। কেউ যদি বাংলাদেশে আসে তাহলে আমাদের হাতে বিমানবন্দরেই ধরা পড়বে।’

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, জঙ্গিরা যেসব গ্রুপে যোগাযোগ করে থাকে, সন্দেহজনক কিছু আলামত মিলেছে সেখানেও। সাইবার-জগতে উগ্রপন্থিদের তৎপরতার দিকেও নজর রাখা হয়েছে। কোনো এলাকায় কেউ নাশকতার চেষ্টা করছে কি না খেয়াল রাখা হচ্ছে সে ব্যাপারেও। তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারণে তারা সংগঠিত হওয়ার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে যারা জঙ্গি সংশ্লিষ্ট কর্মকা-ে অংশ নিয়েছিল তারা যাতে কোনোভাবেই দেশে প্রবেশ করতে না পারে, তাদের এমন ৪০ জনের একটি তালিকা দেশের সব কটি বিমান, নৌ ও স্থলবন্দরে পাঠানো হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে, সিরিয়া ও ইরাকে আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে ১১০টি দেশ থেকে ৪০ হাজারেরও বেশি বিদেশি যোদ্ধা গিয়েছে। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে ৮০০, মালয়েশিয়া থেকে ১৫৪, ফিলিপাইন থেকে ১০০ এবং বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে ৪০ জন। সিরিয়ায় আইএসের পতনের প্রেক্ষাপটে ইউরোপের যে আইএস যোদ্ধারা নিজ দেশে ফিরতে চেয়েছেন, তাদের ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থানের কথা জানিয়েছে ওই সব দেশ। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ও মনিটরিং সেন্টারের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান বলেন, ‘সাইবার ওয়ার্ল্ড আমাদের নজরদারির বাইরে নয়। আমাদের নজরদারির বাইরে গিয়ে কেউ কিছু ঘটাতে পারবে এমনটা আমরা ভাবতে চাই না। তবে এর পরও আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, ক্রাইস্টচার্চ হামলার পর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বুধবার পুলিশ সদর দফতর থেকে সারা দেশে সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। সে হিসেবে ঢাকার মন্দির ও গির্জার ওপর রাখা হয় বিশেষ নজরদারি। র‌্যাব-পুলিশ ধর্মীয় উপাসনালয়ের আশপাশের সড়কেও তল্লাশিচৌকি বসিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। শ্রীলঙ্কার হামলার পর থেকে আরও সতর্ক র‌্যাব-পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।

রাজধানীর গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় নিখুঁতভাবে গাড়ি তল্লাশি করে যাতায়াতের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। সন্দেহ হলেই তল্লাশি করা হচ্ছে পথচারীদের দেহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা এখনো অত্যন্ত নাজুক। কেবল আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে নিরাপত্তা ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে এখনো অনেকে অনেক বড় বড় কাজ হাসিল করে ফেলছেন। তবে জঙ্গিবাদের মতো বৈশ্বিক ইস্যু নিয়ে কখনো তৃপ্তির ঢেকুর তোলা কারও উচিত হবে না। কারণ এখনো রেডিক্যালাইজেশনের সংস্কৃতি বিদ্যমান। এ জন্য প্রয়োজন অ্যাডভান্সড প্রিপারেশন।’ র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘দেশের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়কেই র‌্যাব বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখে। নিউজিল্যান্ড কিংবা শ্রীলঙ্কার ঘটনা সবকিছুকেই আমরা সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছি। আমাদের প্রতিটি ব্যাটালিয়নকে এ অনুযায়ী বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর