বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

বন্ড সুবিধার ৫১ কোটি টাকার পণ্যে অনিয়ম

বন্ডের পণ্য কালো-বাজারে বিক্রিতে উদ্বেগ বাড়ছে, বিশেষ অভিযানে নামছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট

রুহুল আমিন রাসেল

শুল্কমুক্ত বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধায় আমদানি হওয়া সাড়ে ৫১ কোটি টাকার পণ্যে অনিয়ম পেয়েছে কাস্টমস। গাজীপুরের মেসার্স অলিম্পিক এক্সেসরিজ লিমিটেডের খোলাবাজারে বন্ড সুবিধার পণ্য অবৈধভাবে বিক্রির ঘটনা উদঘাটন করা হয়েছে। জানা গেছে এভাবে কালোবাজারে বন্ডের পণ্য বিক্রি হওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে। প্রতিদিনই অবৈধভাবে ট্রাকে ট্রাকে বিক্রি হচ্ছে পণ্য। চোরকারবারিদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্যে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এবার বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ঠেকাতে বিশেষ অভিযানে নামছে ঢাকা কাস্টম বন্ড কমিশনারেট। এ লক্ষ্যে আজ জরুরি বৈঠক ডেকেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআর। তথ্য কাস্টমসের। জানা গেছে, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং ঢাকা কাস্টম বন্ড কমিশনারেটের যৌথ অভিযানে মেসার্স অলিম্পিক এক্সেসরিজ লিমিটেডের অবৈধভাবে কালোবাজারে বন্ড সুবিধার পণ্য বিক্রির ঘটনা উদঘাটন করেছে। শুল্ক ও করসহ ওই পণ্যের মোট মূল্য ৫১ কোটি ৫৩ লাখ ৯৯ হাজার ৫২ টাকা। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ৬, ৭ ও ১৯ এপ্রিল শুল্ক গোয়েন্দার সহকারী পরিচালক আবু হাসানের নেতৃত্বে সাত সদস্যের প্রতিনিধি দল ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আরেকটি দল অলিম্পিক এক্সেসরিজ লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর বিজয় নগরে আকস্মিক পরিদর্শন করেন। প্রতিষ্ঠানটির ওয়্যারহাউস সমূহে থাকা কাঁচামাল গণনা করে বন্ড রেজিস্টারে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত প্রদর্শিত কাঁচামালের সর্বশেষ মজুদের সঙ্গে তুলনা করে পরিমাণে কম পাওয়া যায়। কম থাকা কাঁচামালের মধ্যে রয়েছে- পলিস্টার টেক্সচার্ড ইয়ার্ন ১০৪ দশমিক ৭৫৮ টন, পিভিসি শিট ২০ দশমিক ৪৯০ টন, বি ও পি পি ৩১ দশমিক ৭৪৪ টন, পি পি ৩৩৩ দশমিক ৯৯৫ টন, আর্ট কার্ড ৫২ দশমিক ৪৭৭ টন, প্রিন্টিং ইনক ৩ দশমিক ৭৬৩ টন, রিবন ৫ দশমিক ১৯০ টন, এল ডি পি ই ২৪২ দশমিক ৫৭৫ টন, অ্যাডহেসিভ টেপ ৩ দশমিক ৩২৮ টন, রাবার থ্রেড ৩ দশমিক ২৪২ টন, পলিস্টার ইয়ার্ন ১০৪ দশমিক ৭৫৮ টন, পলিস্টাইরিন ১৮ টন, কাগজ জাতীয় পণ্য লাইনার পেপার ৬০ দশমিক ৩১ টন, মিডিয়াম পেপার ১০ দশমিক ৬১ টন, গাম টেপ ৭ দশমিক ৭১ টন, ডুপ্লেক্স বোর্ড ৫০১ দশমিক ৫০২ টন। এর আমদানি মূল্য ১১ কোটি ২১ লাখ ৮৫ হাজার ৪৩১ টাকা। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই সময়ে ২৫ কোটি ৪১ লাখ ২৪ হাজার ৬২৬ টাকার কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণের তথ্য মিলেছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি সর্বমোট ৩৬ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার ৫১ টাকা মূল্যমানের আমদানি হওয়া কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করেছে। অবৈধভাবে অপসারিত ওই কাঁচামালের ওপর শুল্ক ও করের পরিমাণ ১৪ কোটি ৯০ লাখ ৮০ হাজার ৯৯৫ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির অন্যান্য অনিয়মসমূহে তদন্ত চলছে এবং শুল্ক আইনে মামলা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম। এদিকে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ঠেকাতে জিরোটলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। সংস্থাটি বিকাশমান দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় বন্ডের পণ্য আমদানি ও গুদামজাতকরণের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে। চলছে অভিযানও।

এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা বন্দর থেকে নামিয়ে সোজা কালোবাজারে বন্ড সুবিধার আমদানি পণ্য বিক্রি করছে। বন্ডে সুবিধার এই অপব্যবহার কঠোর হাতে দমন করা হবে।

এদিকে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ঠেকাতে গিয়ে চোরাকারবারিদের হাতে কাস্টমস কর্মকর্তারা রক্তাক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে আজ ২৫ এপ্রিল জরুরি সভা আহ্বান করেছে এনবিআরের শুল্ক, রপ্তানি ও বন্ড শাখা। এর দ্বিতীয় সচিব কিশোয়ারা শিরিন স্বাক্ষরিত পত্রে ওই সভায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের বন্ড কমিশনার, শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক, রংপুর ও মোংলা কাস্টমস হাউসের কমিশনারকে ডাকা হয়েছে। জানা গেছে, শুল্কমুক্ত বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধায় আমদানি হওয়া পণ্য চোরাই পথে কালোবাজারে বিক্রয় প্রতিরোধে রাত-দিন অভিযান পরিচালনা করছেন ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা। গত ১৮ এপ্রিল মধ্যরাতে পুরান ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অভিযান চালায় কাস্টমস। সে অভিযানে চোরাকারবারিদের ভয়ঙ্কর হামলায় রক্তাক্ত হয়েছেন ঢাকা কাস্টম বন্ড কমিশনারেটের ছয় কর্মকর্তা। রাজধানীর নয়াবাজারে প্রায় ৪০ জন কাস্টমস কর্মকর্তাদের অভিযানে বন্ড সুবিধায় আমদানি হওয়া চোরাই কাগজ জাতীয় পণ্যসহ ৩ কাভার্ড ভ্যান আটক করেছে কাস্টমস। ওই সব চোরাই পণ্য আটক শেষে কাস্টমস কর্মকর্তারা ফিরে আসার সময় অবৈধ চোরাকারবারি চক্রের দুষ্কৃতকারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে বিনা প্ররোচনায় ইটপাটকেল, লাঠিসোঁটা নিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। কাস্টমসের একটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। এদিকে কাস্টমস হাউস ও বন্ড কমিশনারেট সংশ্লিষ্ট মামলাসমূহের সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনার লক্ষ্যে সম্প্রতি এক সভা হয় এনবিআরে। ওই সভার কার্যবিবরণীর তথ্যমতে- এনবিআরের ছয়টি কাস্টমস হাউস ও দুটি কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সংশ্লিষ্ট ১৫ হাজার ৯৫১টি মামলা বিভিন্ন দফতরে বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলা সমূহের সঙ্গে সরকারের ৮ হাজার ১৯১ কোটি ৬৩ লাখ টাকার রাজস্ব আটকে আছে। সরকারের চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর