শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

মমতার নতুন তোপ

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

মমতার নতুন তোপ

পশ্চিমবঙ্গে লোকসভার ভোট মধ্যগগনে। এর মধ্যে মমতা-মোদির ‘কুর্তা ও মিষ্টি’ সৌজন্যকে কেন্দ্র করে শুরু হয়ে গেল নতুন রাজনীতি। বুধবার বলিউড সুপারস্টার অক্ষয় কুমারের সঙ্গে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলে ফেলেছিলেন বিরোধী দলের একাধিক নেতার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এ প্রসঙ্গেই মোদি বলেন- ‘প্রতি বছরই মমতা দিদি আমাকে কুর্তা ও মিষ্টি পাঠান।’ ব্যস! একদিন পর বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীকে পাল্টা নিশানা করে দিদি বললেন- রাজনৈতিক মাইলেজ পাওয়ার জন্যই মোদিজি কুর্তা ও মিষ্টি সৌজন্যতাকে ব্যবহার করছেন। বুধবার দিল্লিতে নিজের বাসভবনে অরাজনৈতিক ওই সাক্ষাৎকারে মোদি খোশগল্প করেন অক্ষয়ের সঙ্গে। তিনি বলেন- ‘লোকে শুনলে অবাক হয়ে যাবেন। ভোটের সময় এই কথা বলতে হয়তো নির্বাচনে আমার ক্ষতিও হতে পারে। কিন্তু তবুও বলছি যে, প্রতি বছরে মমতা দিদি নিজে পছন্দ করে আমার জন্য দু-একটা কুর্তা (পাঞ্জাবি) উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দেন।’ মোদি আরও বলেছিলেন- ‘প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি পাঠাতেন। মমতা দিদি তা জানার পর তিনিও আমাকে মিষ্টি পাঠাতে শুরু করেন।’ শুধু মমতাই নন, বিরোধী দলের একাধিক নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে তার সুসম্পর্কের কথা জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। মোদির মুখ থেকে মমতার সঙ্গে সম্পর্কের এই দিক প্রকাশ্যে আসতেই ফের তৃণমূল-বিজেপির আঁতাতের অভিযোগ তোলে বিরোধীরা। সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন- ‘মুখ্যমন্ত্রী এখানে খুব চেঁচামেচি করছেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জেনেই হোক আর না জেনেই হোক-হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন যে উনি (মমতা) জামা-কুর্তা পাঠান।

আর ওখান থেকে হাসিনা যেহেতু মিষ্টি পাঠাতেন তাই সেটা জানার পর উনি (মমতা) মিষ্টিও পাঠাতে লাগলেন। আমরা জানি গুজরাট দাঙ্গার পর মমতা উনাকে (মোদি) ফুল পাঠিয়েছিলেন। এদের চরিত্র আমরা আগে থেকেই জানি।’

বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সিউড়িতে এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতার সময় মোদিকে তোপ দেগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেন, সৌজন্যতা নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক নয়। কুর্তা প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘মোদিবাবু একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন- আমি তাকে নাকি কুর্তা পাঠাই। আরে পাঠালে দোষটা কোথায়? দুর্গাপুজোয় তো আমরা সবাইকেই কিছু না কিছু পাঠাই। আমার বিশ্ববাংলা দোকান আছে। বিশ্ববাংলা আমার বাংলার ব্র্যান্ড, সেখানে আমার তাঁতিরা কাজ করে। বর্ধমান, হুগলি, মুর্শিদাবাদ, বীরভূমের তাঁতিরা আমায় তৈরি করে দেয়। সেই জিনিস থেকে কেবল নরেন্দ্র মোদিই নন, আমি অনেককেই পাঠাই-যারা বিভিন্ন জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আছেন। তবে হ্যাঁ ওরা বলে দেয়, আমরা বলি না। তার কারণ আমাদের এটা সংস্কৃতি নয়। আমরা পয়লা বৈশাখে লোককে মিষ্টি পাঠাই। আমরা দুর্গাপুজোয় লোককে উপহার পাঠাই। আমার এখানে যখন আম হয় তখন সেই আম সবার কাছে পাঠাই।’

রাজনীতির স্বার্থে তার সৌজন্যতাবোধকে নিয়ে মার্কেটিং করা হচ্ছে বলেও মোদিকে তোপ দাগেন মমতা। তিনি বলেন ‘উনি (মোদি) তো নিজের নামটা বলেছেন। আর আমি আপনাদের এক শতাধিক নাম বলতে পারি। কই আমরা তো কখনো এ কথা বলি না। তার কারণ এটা হচ্ছে সৌজন্যবোধ এবং সৌজন্যবোধ ও রাজনীতি দুটো পৃথক জিনিস। আমি তো সবার জন্মদিনে চিঠি পাঠাই। আপনার জন্মদিনেও পাঠাই। আমরা তো কারও মৃত্যু কামনা করি না। সবার শুভ কামনা করি। সুতরাং এভাবে রাজনীতি করা ... সৌজন্যবোধকেও বাজারে মার্কেটিং করা ... ইমেজ বিল্ড আপ করছে। এতে ইমেজ বিল্ড আপ হয় না।’

মমতার দাবি- ‘আমরা তবে কত ভদ্রতা করি বলুন, কিন্তু আপনি তো রোজই এসে আমাকে চমকান। সিবিআইকে দিয়ে চমকান। রোজই আমাকে গু া বলেন। আমি যদি গু া হই, তবে নরেন্দ্র মোদি আপনি কী? আমার হাত দিয়ে কখনো দাঙ্গা হয়নি, আমি দাঙ্গায় লোক মারি না। আমি রক্তের রাজনীতি করি না। কিন্তু আপনার কি ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গার কথা মনে পড়ে?’

তবে ‘কুর্তা বা মিষ্টি’ পাঠানোর বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসার রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলার মুসলিম ভোটারদের কাছে মমতার ভাবমূর্তিকে ক্ষুণœ করারও একটা সূক্ষ্ম  প্রচেষ্টা করা হচ্ছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। মোদি খুব সরল ও স্বাভাবিকভাবেই বলেছেন যে তিনি প্রতি বছর কুর্তা ও মিষ্টি পেয়ে থাকেন, এর মধ্যে মমতার সঙ্গে তার যে একটা সুদৃঢ় সম্পর্ক আছে তারও ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তথাপি বিভিন্ন সভা বা র‌্যালিতে মোদিবিরোধী মন্তব্য করে মমতা তার চারপাশের মানুষদের সংঘবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেন।

তবে এটা ঠিক যে কেবল মোদিই নন, দিল্লিসহ অন্য অঞ্চলের শীর্ষ স্তরের রাজনৈতিক নেতাদের নিয়মিত উপহার দিয়ে থাকেন মমতা। মিষ্টি ছাড়াও রয়েছে রাজ্যের প্রসিদ্ধ পোশাকজাত দ্রব্য, প্যাকেটজাত আম। যদিও ভারতে আম-রাজনীতি শুরু হয়েছিল মালদহের বাসিন্দা সিনিয়র কংগ্রেস নেতা ও সাবেক রেলমন্ত্রী প্রয়াত এ বি এ গণি খান চৌধুরীর হাত ধরে। তিনিই প্রথম বাক্সবন্দী করে সুস্বাদু ‘কোহিতুর’ আম পাঠাতেন রাজীব গান্ধী, জ্যোতি বসুদের।

১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মমতা ব্যানার্জি যখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএর শরিক ছিলেন তখন তিনিও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি, লালকৃষ্ণ আদভানি, রাজনাথ সিংসহ অন্য রাজনীতিকদের জন্য মিষ্টি, সুতির শাড়ি পাঠাতেন। এমনকি ১৯৯৮ সালে মমতা যখন কংগ্রেসের সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে এসে নতুন দল গঠন করেন তার পরও কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলতেন এবং নিয়মিত উপহার পাঠাতেন। পরবর্তীতে কেন্দ্রে যখন নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলেন তখনো মোদি এবং অমিত শাহ-উভয়কেই তার অতিথিদের তালিকায় রেখে উপহার পাঠাতে থাকেন। এমনকি ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পরও জাতীয় রাজনীতিতে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে সেই ‘আম এবং মিষ্টি’ রাজনীতির ওপরই ভরসা রাখলেন। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু-ই হোক আর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল বা কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী এইচ.ডি. কুমারস্বামীসহ অন্য আঞ্চলিক নেতাদের বাসায় নিয়মিত উপহার পাঠাতে থাকেন।

তবে সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে উপহার পাঠানো বা কোনো অনুষ্ঠান উদযাপন করা সৌজন্যের নজির হিসেবেই ধরা হয়ে থাকে এবং এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক অর্থ খোঁজা ঠিক নয়। কিন্তু রাজ্যে যেখানে মোট ভোটারের ৩০ শতাংশ মুসলিম, সেখানে মোদির এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে মমতার রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে মুসলিম ভোটারদের মনে সন্দেহের বীজ বপনের চেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে। সবকিছুর পর এখন প্রশ্ন একটাই-আগামী দিনে এই ‘মিষ্টি ও আম’ কূটনীতি কি ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে আরও কাছাকাছি আসবেন মমতা ব্যানার্জি ও নরেন্দ্র মোদি? জল্পনা আরও জোরালো হচ্ছে, কারণ এর আগেও ১৯৯৯-২০০৪ পর্যন্ত কেন্দ্রে বিজেপির জোট সঙ্গী ছিলেন এই মমতা। তাছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে পানি বিনিময় থেকে শুরু করে নিজেদের ভোটব্যাংক বজায় রাখা-সব ক্ষেত্রেই মোদি ও মমতার একে অপরকে ভীষণ ভাবেই জরুরি।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর