শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

বুড়িগঙ্গাসহ চার নদীতীরে নির্মাণ হচ্ছে ওয়াকওয়ে ইকোপার্ক জেটি

‘মারপ্যাঁচে’ কর্ণফুলীর উচ্ছেদ, তুরাগে ৪৪ স্পটে উচ্ছেদ

নিজামুল হক বিপুল

ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর উদ্ধার হওয়া তীর রক্ষায় ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী চার নদীর তীর উদ্ধার করে সেখানে সীমানা পিলার, ওয়াকওয়ে, পন্টুন, জেটি, গাইড ওয়াল, ইকোপার্ক নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাে র জন্য আট হাজার ৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে সরকার। সরকারের গত মেয়াদের শেষ দিকে অক্টোবর মাসে তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান ওই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় উদ্ধার হওয়া নদী তীরে এখন কাজ শুরু হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর চারপাশ ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর দুই তীর রক্ষায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। মহাজোট সরকারের আমলে গত বছর শুরু হওয়া উচ্ছেদ অভিযান ঢিমেতালে চললেও বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর উচ্ছেদ অভিযানের বিষয়ে কঠোর নীতি নিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে এবং নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর কঠোর অবস্থানের কারণে তার দায়িত্ব নেওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই শুরু হয় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও নদী তীর দখলকারী প্রভাবশালীদের সব ধরনের তদবির উপেক্ষা করে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান চলছে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে। প্রথম ধাপে দখলে-দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত এবং হুমকির মুখে থাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর তীর রক্ষার জোর অভিযান চালানো হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ বলছে, চার নদী তীরের সব স্থাপনা উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে। কাউকে আর অবৈধ স্থাপনা তৈরি করতে দেওয়া হবে না।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, গত ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালিত অভিযানে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর দুই তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে তিন হাজার ১৭৫টি। যার মধ্যে পাকা দালানকোঠা থেকে শুরু করে আধাপাকা ও টিন শেডের বাসা-বাড়ি, দোকানপাট ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুদামঘর ছিল। এ সময়ের মধ্যে নিলাম থেকে বিআইডব্লিউটিএর আয় হয়েছে চার কোটি পাঁচ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। আর জরিমানা আদায় হয়েছে প্রায় চার লাখ টাকা। এদিকে বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর কর্তৃপক্ষ দুই দফা অভিযান চালিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর দুই তীর থেকে এ পর্যন্ত ১৯২টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। এর মধ্যে দোতলা ও একতলা পাকা বাড়ি রয়েছে ৫০টি। নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের যুগ্ম-পরিচালক মো. গুলজার আলী জানান, তাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। এদিকে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর সীমানা পিলার স্থাপন, ওয়াকওয়ে, জেটি, ইকোপার্ক, পন্টুন নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নূরুল আলম গতকাল জানিয়েছেন, প্রায় সাড়ে আট শত কোটি টাকার এ প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে চারটি পৃথক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে খুব শিগগিরই কার্যাদেশ দেওয়া হবে। তিনি জানান, প্রথম ধাপে সাড়ে তিন কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে কামরাঙ্গীরচর থেকে বসিলা পর্যন্ত। এরপর পর্যায়ক্রমে উদ্ধার হওয়া বাকি অংশেও ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজে হাত দেওয়া হবে।

আইনের ‘মারপ্যাঁচে’ কর্ণফুলীর উচ্ছেদ : রেজা মুজাম্মেল চট্টগ্রাম থেকে জানান, আইনের মারপ্যাঁচে পড়েছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ। ফলে ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া। উচ্ছেদ কার্যক্রম বিলম্ব হওয়ায় ফাঁকে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন স্থাপনা। এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে ১৯৫৯টি স্থাপনা। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে প্রশাসনের ভূমিকা। পক্ষান্তরে, কর্ণফুলী নদীর এমন নাভিশ্বাস অবস্থায় গত রবিবার সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার। নদী দখল-দূষণের নাজুক পরিস্থিতি দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা উন্নয়ন চাই, তবে নদীর কণ্ঠরোধ করে নয়। নদী দখল করে যেভাবে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা স্থাপনা তৈরি করেছে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা বন্দর, জেলা প্রশাসন, সিডিএসহ সবাইকে চিঠি লিখছি।’ গত এপ্রিলে উচ্চ আদালতের নির্দেশে কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলে এর বিরুদ্ধে একাধিক প্রতিষ্ঠান রিট আবেদন করে। ফলে স্থবির হয়ে পড়ে উচ্ছেদ কার্যক্রম। অভিযান পরিচালনাকারী জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘একের পর এক আইনি মারপ্যাঁচে পড়ছে উচ্ছেদ কার্যক্রম। আশা করছি, খুব শিগগিরই আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে উচ্ছেদ কার্যক্রম আবারও শুরু হবে।’ আদালতে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আর কোনো বাধা নেই। আদালত বন্দরকে যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা বৃহস্পতিবার বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। আশা করি, বন্দরও এ ব্যাপারে তৎপরতা শুরু করবে।’ 

তুরাগ তীরে উচ্ছেদ : সাভার ও টঙ্গী প্রতিনিধি জানান, গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে আশুলিয়ার ধউর সেতু পর্যন্ত তুরাগ তীরে ৪৪টি স্পটে উচ্ছেদ অভিযান চালায় বিআইডব্লিউটিএ। বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম-পরিচালক ও ঢাকা নদীবন্দর নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা এ কে এম আরিফ উদ্দিনের নেতৃত্বে অভিযানে তুরাগ নদীর পাড়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা নাভানা পাইপ ফিটিংসয়ের গোডাউন, ডম ইনো কংক্রিট, ম্যাক্রো মটরস অ্যান্ড পানি সার্ভিসিং সেন্টার ও ইব্রাহিম স্যানেটারি ওয়ার্কশপসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া উচ্ছেদ হওয়া জমি ভরাট করা বালু নিলামে বিক্রয় করা হয়। আরিফ উদ্দিন বলেন, রাজধানীর চারপাশের নদ-নদী উচ্ছেদ শেষে অবৈধ দখলকারীদের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের জন্য মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ। এ জন্য বুড়িগঙ্গা-তুরাগের দখলদারদের একটি নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি না হলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। অভিযানটি চলবে টানা কয়েক দিন।

সর্বশেষ খবর