শুক্রবার, ৩ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

অভিযানের পরও চলছে কেমিক্যাল ব্যবসা

পুরান ঢাকার আগের চিত্র, কোথাও পরিবর্তন নেই

মাহবুব মমতাজী

অভিযানের পরও চলছে কেমিক্যাল ব্যবসা

পুরান ঢাকার নিমতলীর পর চকবাজার। ঘটনা ঘটলেই শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। এরপর সব শেষ। এবারও ব্যতিক্রম নেই। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর আলোচনায় আসে ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যবসা। চিহ্নিত করা হয় প্রতিটি বাড়ির নিচে থাকা কেমিক্যাল গোডাউন। এসব কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের গোডাউন সরাতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে বিভিন্ন সেবা সংস্থার সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার।

প্রায় মাসখানেক চলে কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণ অভিযান। এরপর ফের ফিরে আসে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যবসার পুরনো চিত্র। যদিও ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, আগেও পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল গোডাউন ছিল না, এখনো নেই। আর টাস্কফোর্সের অভিযানটি ছিল ভুল। কেমিক্যাল নেই, তবুও বিভিন্ন বাড়ির গ্যাস, পানি-বিদ্যুতের মতো পরিসেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় তারা। এদিকে ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকিতে থাকায় পুরনো ঢাকায় আরও ৭২টি মার্কেট ও ভবন চিহ্নিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। লালবাগ ফায়ার স্টেশন প্রতি সপ্তাহে ওইসব ভবনের মালিকদের সতর্কবার্তা দিয়ে আসছে। গত সোমবার চুড়িহাট্টায় নন্দ কুমার দত্ত রোডে ৬৯/২ নম্বর ভবনে গিয়ে দেখা গেছে কেমিক্যালের গোডাউন। ভবনটির নিচে থাকা দি কালার কোম্পানি নামের দোকানটি প্লাস্টিক দানা, রংসহ নানা ধরনের কেমিক্যাল উপকরণে সাজানো। আর দোকানের পেছনেই সাততলা এ ভবনের ওপরে ওঠার সিঁড়ি। ২য় ও ৩য় তলায় রয়েছে তাদের গোডাউন। গত ৪ মার্চ এই ভবনের পরিসেবা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল টাস্কফোর্স। একই রোডের ৭ নম্বর ও হরনাথ ঘোষ রোডের ৯৫/৫ নম্বর ভবনের চিত্রও ছিল একই। নিচে কেমিক্যালের গোডাউন, আর ওপরে মানুষের বসবাস। এদিন নাজিরাবাজার, সিদ্দিকবাজার, হাজারীবাগ, তাঁতীবাজার ও চকবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে এমন ২৯টি ভবনের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। দি কালার কোম্পানি নামে দোকানটির কর্মচারী পরিচয় দেওয়া এক বয়সী ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে জানান, আমাদের এখানে কখনোই কেমিক্যাল ছিল না, এখনো নেই। সংযোগ বিচ্ছিন্নের কয়েকদিন পরই তা পুনঃসংযোগ করে দেয় সিটি করপোরেশন। যদি আমাদের এসব দোকান কিংবা গোডাউন বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাবে। কেমিক্যাল এবং প্লাস্টিক কারখানা থাকায় গত ২ মার্চ বকশীবাজারের জয়নাগ রোডের চারটি বাড়ির পরিসেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এ ঘটনার প্রায় ১৫ দিন পর পুনরায় সে সব সংযোগ দেওয়া হয়। ১৬/২/বি নম্বর বাড়িতে থাকা প্লাস্টিক কারখানার বিপ্লব নামে এক কর্মচারী জানান, বিচ্ছিন্নের সপ্তাহখানেক পর আমরা সিটি করপোরেশনে আবেদন করি এবং জানাই- আমাদের কোনো কেমিক্যাল গোডাউন নেই। এরপর তারা এসে আবার সংযোগ দিয়ে যায়। একই দিনে লালবাগের শহীদনগরের রাজ নারায়ণ দত্ত (আরএনডি) রোডের ৩৫, ৩৫/১, ৮, ১১, ৬/এ, ৬/বি, ২৫২, ২৯০/২ এবং ৪২/৫ নম্বর বাড়িগুলোর পরিসেবা বিচ্ছিন্ন করা হয়। ৩৫ নম্বর বাড়ির পাশে থাকা শরীফ স্টোর নামে দোকান মালিক জানালেন সিটি করপোরেশনের অভিযানের পর সব সংযোগ বন্ধ। অথচ ৩৫ এবং ৩৫/১ নম্বর বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখা যায় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ রয়েছে। নিচতলায় একটি জুতার কারখানাও দেখা যায়। বাড়ির ম্যানেজার মনিরের স্ত্রী জানালেন, জুতার কারখানার কেমিক্যালের জন্য বাড়ির সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। পরে জুতার কারখানায় কেমিক্যাল নাই- এমন কথা বলার পর আবার সংযোগ দিয়ে দেয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্র জানায়, কেমিক্যাল গোডাউন রাখার অভিযোগে টাস্কফোর্সের অভিযানে ১০২টির মতো বাড়ির পরিসেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সতর্ক করে দেওয়া হয় ৯৭টির। টাস্কফোর্সের ৫টি টিম পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এসব অভিযান পরিচালনা করে। টাস্কফোর্সের অভিযানে নেতৃত্বে থাকা ডিএসসিসি’র প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মো. জাহিদ হোসেন এ প্রতিবেদককে জানান, কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণ অভিযানের পর ওই এলাকায় আমাদের কোনো ফরমাল নজরদারি নেই। তবে ইনফরমাল নজরদারি রয়েছে। আমরা বাসিন্দাদের অনুরোধ করেছি যে- কোথাও কোনো কেমিক্যালের গোডাউন থাকলে গোপনে যেন আমাদের জানানো হয়।

ঝুঁকিপূর্ণ পুরান ঢাকার আরও ৭২টি ভবন : ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ৭২টি ভবন ও মার্কেটকে চিহ্নিত করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিদর্শন টিম। ফায়ার সার্ভিসের লালবাগ স্টেশন সূত্র জানায়, ঝুঁকিপূর্ণ সেই ভবনগুলো হলো- চকবাজারের হাজী আবদুস সালাম ম্যানশন, ভূঁইয়া প্লাজা, আশরাফ মার্কেট, আলাউদ্দিন মার্কেট, ফারজানা টাওয়ার, দারুল লেবাস মার্কেট, জাকারিয়া ম্যানশন, নাহার ভবন, জোছনা ভবন, শাকিব আনোয়ার টাওয়ার, হালিমা মার্কেট, জহরা ম্যানশন, চক ম্যানশন, হাজী ম্যানশন, আর করিম মার্কেট, সুলতান ম্যানশন, হাজী ভবন, আবেদা ম্যানশন, মোস্তফা টাওয়ার, শহিদুল্লা মার্কেট, আল আমিন মার্কেট, জরিনা ভবন, হাজী আ. খালেক ম্যানশন, আমিন মার্কেট, মসজিদ মার্কেট, ইকবাল মার্কেট, চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদ মার্কেট, লতিফ প্লাজা, কালাচাঁদ মার্কেট, শরীফ ম্যানশন, মহানগর প্লাজা, এইচএইচ প্লাজা, নাসার ম্যানশন, মদিনা কামাল টাওয়ার, রমজান মার্কেট, নুরজাহান ভবন, চকবাজার সিটি মার্কেট, আজমেরী সুপার মার্কেট, ইয়াকুব মার্কেট, হাজী সোনামিয়া মার্কেট, শামসুদ্দিন প্লাজা, মেসার্স সেলিম অ্যান্ড সন্স, মদিনা আসিক টাওয়ার, খান মার্কেট, মোহাম্মদ আলী মার্কেট, মনসুর খান প্লাজা, হায়দার মার্কেট, মদিনা মার্কেট, জিএম ট্রেড সেন্টার, খাজা সুপার মার্কেট, নাসিমা প্লাজা, হাজী মো. হোসেন ম্যানশন, চক ম্যানশন, ভাই ভাই মার্কেট, হাজী এম হাসেম মার্কেট, ইসলাম ম্যানশন, এসি মসজিদ মার্কেট, গাউসিয়া মার্কেট, লতিফ মার্কেট, আলিফ ম্যানশন, আ. কাদের প্লাজা, সামসুল হক টাওয়ার, মক্কা মদিনা টাওয়ার, হাজী সাদেক ম্যানশন ও সিরাজ টাওয়ার।

চুড়িহাট্টার সেই ওয়াহেদ ম্যানশন : অগ্নিকান্ডের দুই মাস পরও চকবাজারের চুড়িহাট্টার ঝুঁকিপূর্ণ ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনটি ভাঙা হয়নি। ভবনটি সংস্কারেরও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ভবনের চারপাশে পলেস্তারা খসে পড়ছে। যে কোনো সময় নতুন দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। গতকাল সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়- সেখানে লাগানো ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন’ লেখা সাইনবোর্ডটি কে বা কারা সরিয়ে ফেলেছে। চুড়িহাট্টা মোড়ে চারতলা ওয়াহেদ ম্যানশনের চারপাশের দেয়াল ও ছাদের পলেস্তারা খসে পড়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি স্থানে পলেস্তারা খসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। প্রধান ফটকে তালা দেওয়া। ভবনটির পশ্চিম ও উত্তর পাশের দুটি গলি দিয়ে রিকশা, ভ্যান চলছে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টার এ ভবনের দ্বিতীয় তলায় কেমিক্যাল থেকে ভয়াবহ অগ্নিকা  হয়। এতে এখন পর্যন্ত ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনার পরদিন ওয়াহেদ ম্যানশনে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন’ লেখা সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয় ডিএসসিসি।

সর্বশেষ খবর