শুক্রবার, ৩ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

ফুলের রাজ্য গদখালী

বকুল মাহবুব, বেনাপোল (যশোর)

ফুলের রাজ্য গদখালী

স্রষ্টা প্রদত্ত সর্বাপেক্ষা মূল্যবান উপহার ফুল, যা কিনা পৃথিবীর সৌন্দর্য বর্ধন করে। কেড়ে নেয় দৃষ্টি। প্রশান্ত করে মন। এককালে শাপলা আর পদ্ম ছিল মিসরীয়দের রাজশক্তির প্রতীক। আর সনাতন ধর্মে দেবতাকে পূজার অর্ঘ্য দিতে ফুল সব সময়ই অপরিহার্য। ১৬-১৭ শতাব্দী জুড়ে নেদারল্যান্ডসে প্রথম কাটফ্লাওয়ার চাষ প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।

এক সময়ের ‘গডকালি মন্দির’ কালের পথপরিক্রমায় আজ ‘গদখালী’। বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী। যশোর সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক যশোর রোডের দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভিবাদন জানায় শতবর্ষী বৃক্ষকুল। বর্তমানে ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ৯০টি গ্রামে প্রায় ৪ হাজার বিঘা জমিতে ফুল চাষ হয়। দিগন্তবিস্তৃত ফুলখেতের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পিচঢালা কালো পথ। চারদিকে শুধু ফুল আর ফুল। বাহারি রঙের ফুলের সুবাস পাগল করে দেয় মন। চলে মৌমাছির গুঞ্জন। যেন সুখের গানে বাণ ডেকেছে। রয়েছে নানা রঙের বাহারি প্রজাতির প্রজাপতির সমারোহ। গদখালীর মধ্য দিয়ে রেলপথ চলে গেছে তারকাটা পেরিয়ে সোজা ভারতে। রেললাইনের দুপাশেই অগণিত ফুলখেত। ট্রেন গদখালীর কাছাকাছি এলেই যাত্রীরা হুমড়ে পড়েন জানালার দিকে। এখানে মৌসুমি ফসলের স্থলে বছরজুড়ে চলে ফুল চাষ। অন্যান্য ফসলের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি উপার্জন হয় ফুল চাষ থেকে। স্বর্গীয় এই ঐশ্বর্য কি অর্থমূল্যে বিচার করা সম্ভব? নিশ্চয়ই নয়। ঘরের আঙিনা থেকে শুরু করে ফসলের মাঠ, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, প্রতিটা স্থানেই ফুল আর ফুল। রয়েছে রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গ্ল্যাডিওলাস, অর্কিড, পাতাবাহার, চাঁদা, জিপসি, রথস্টিক, লিলিয়াম, গ্যালাডোলা, চন্দ্রমল্লিকা। রয়েছে লং স্টিক রোজ, কার্নিশনসহ নানা প্রজাতির ফুল, যারা রঙিন শয্যা বিছিয়ে আহ্বান করে সৌন্দর্যপিয়াসীদের। সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দেয় বাংলার বাতাসে। প্রজাপতিরা ডানায় করে সৌরভ আর সুন্দরের বার্তা বয়ে নিয়ে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। রয়েছে নজরকাড়া সব পলিহাউস, যেখানে দামি দামি ফুল অতি যতেœ চাষাবাদ করা হয় আলো ও বৃষ্টির চরম প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য। একেকটা পলিহাউস কয়েক একর জুড়েও হয়ে থাকে। শেডে ঢুকলেই আনন্দে হৃদয় মেতে উঠে। মুছে যায় মনের মলিনতা। দৃষ্টির সীমানায় ভেসে উঠে নতুন এক রাজ্য। নতুন স্বপ্ন। ১৯৮২ সালে প্রথম বাণিজ্যিক চাষ শুরু।

বর্তমানে দেশের মোট ফুলের ৭০ শতাংশ উৎপাদিত হয় গদখালীতে, যা থেকে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। সীমিত পরিসরে রপ্তানিও হয়ে থাকে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে উৎপাদন বেশি। আর বিক্রি বেশি ফেব্রুয়ারিতে। এখানে ৬ হাজার চাষি এবং প্রায় ৫০ হাজার লোক সরাসরি ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত, যাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ নারী। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাঙালিরা এখন স্বাধীন মনে স্বপ্ন বুনতে জানে। আন্তর্জাতিক মানের অনুষ্ঠানও জানে সফলভাবে সম্পন্ন করতে। অতিথিকে শুভেচ্ছা এ দেশে ফুল ছাড়া বেমানান। মৃত ব্যক্তির দেহাবশেষে ফুল প্রদান নিত্য ঘটনা। প্রেম প্রস্তাব, সেটি কি আর ফুল ছাড়া সম্ভব! আর বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদ্্যাপন ফুল ছাড়া অকল্পনীয়! ফলে বহুগুণে বেড়েছে ফুলের ব্যবহার ও চাহিদা। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে ফুল সংস্কৃতির বিপ্লব। বর্তমানে বিশ্বের ৬৮ শতাংশ ফুল সরবরাহ করে হল্যান্ড। ফুল রপ্তানি থেকে দেশটির মোট রপ্তানি আয়ের এক-পঞ্চমাংশ আসে। সামষ্টিক সুনজর থাকলে গদখালীও হতে পারে প্রাচ্যের হল্যান্ড। বিশ্ববাজারে ফুল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে বাংলাদেশ। এ জন্য প্রয়োজন বৃহৎ পরিসরে কোল্ডস্টোরেজ, ফুল গবেষণাকেন্দ্র, চাষিদের জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা, যা রপ্তানি আয়ে যোগ করতে পারে নতুন মাত্রা। আর দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য গদখালী হতে পারে আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, যশোরের ঝিকরগাছা, শার্শাসহ অন্যান্য উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে। ১৯৮৩ সালে গদখালীতে মাত্র ৩০ শতক জমিতে ফুল চাষ শুরু হয়। এখন চাষ হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে। দেশে ফুলের মোট চাহিদার ৭০ ভাগই যশোরের গদখালী ও শার্শা থেকে সরবরাহ করা হয়। দেশের গ-ি পেরিয়ে এই ফুল এখন যাচ্ছে দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ায়ও। সরকারিভাবে বৃহৎ পরিসরে কোল্ডস্টোরেজ, ফুল গবেষণাকেন্দ্র, চাষিদের জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে উন্মোচিত হতে পারে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর