শিরোনাম
শুক্রবার, ৩ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্যার, ওষুধের নাম কী

মির্জা মেহেদী তমাল

স্যার, ওষুধের নাম কী

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী। গুলশানে অফিস শেষে দাওয়াত খেতে উত্তরায় যান। সেদিন বাসায় ফিরতে একটু রাত হয়ে যায় তার। বাস থেকে নেমে ফার্মগেট থেকে পান্থপথের বাসায় যাচ্ছিলেন রিকশায় করে। রিকশাটি পান্থপথ দিয়ে যাওয়ার সময় রিকশাচালক তাকে বলে, স্যার একটু বসেন। আমি ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে আসি। মোহাম্মদ আলী তাকে বললেন, যান, তাড়াতাড়ি  করবেন।  রিকশাচালক দোকানে গিয়ে ফিরে আসে দ্রুত। তার হাতে ভাঁজ করা কাগজ। মোহাম্মদ আলীকে কাগজটি দিয়ে বলে, স্যার একটু দেখবেন ওষুধের নাম কী? দোকানের লোক বুঝতে পারছে না। মোহাম্মদ আলী কাগজটি হাতে নিয়ে খুলে দেখতে পান প্রেসক্রিপশন। কিন্তু অনেক ছোট করে লেখা। রাতে ভালো করেও দেখতে পারছিলেন না। তিনি কাগজটি খুব কাছ থেকে দেখার জন্য কাছাকাছি এনে পড়ার চেষ্টা করেন। এরপরই মোহাম্মদ আলী আর কিছু বলতে পারেননি। তিনি নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করেন। পরে জানতে পারেন, জ্ঞান হারিয়ে তিনি রাস্তায় পড়েছিলেন। পথচারীরা তাকে উদ্ধারের পর পকেট হাতরে একটি কাগজ পান। সেখানে মোহাম্মদ আলীর ভাইয়ের ফোন নম্বর ছিল। তাকে খবর দেওয়া হয়। তার ভাই মোহাম্মদ আলীর পরিবারের কাছে সংবাদ দেয়। ৫ দিন চিকিৎসার পর মোহাম্মদ অলী বাসায় ফেরেন। মোহাম্মদ আলী তার মোবাইল ফোন ও পকেটে থাকা কিছু টাকা খোয়ান। বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা এটি। প্রকৌশলী সাইফুল্লাহ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বরপা এলাকার একটি গার্মেন্টের কর্মকর্তা। তিনি অফিসের কাজে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিলেন। বাসের মধ্যে এক ব্যক্তি পত্রিকা পড়ার ছলে তার মুখের সামনে সেটি মেলে ধরে। এতে তাৎক্ষণিক ঝিমুনি আসে সাইফুল্লাহর। এরই মধ্যে দুই ব্যক্তি জোর করে ‘ভালো লাগবে’ বলে তাকে একটা কিছু খাইয়ে দেয়। ঘটনার দুই দিন পর নিজেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করেন সাইফুল্লাহ। তার সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন ছিল, যা খোয়া গেছে। হাসপাতালে দুই দিন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফেরেন তিনি।

একই রকমের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। শোভন নামে এক ব্যক্তি জানান, তিনি রিকশায় করে বাসায় ফিরছিলেন। আফমি প্লাজার সামনে গিয়ে রিকশাচালক তাকে একটা কাগজ দিল। সে পড়ালেখা জানে না, শোভন যাতে একটু পড়ে দেন। কাগজ খুলে তিনি দেখেন প্রেসক্রিপশন। খুবই ছোট হাতের লেখা। চোখের একেবারে কাছে নিয়ে শোভন পড়ার চেষ্টা করেন। ঠিক তখনোই কড়া একটা গন্ধ তাকে প্রায় অবশ করে দিচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই কাগজটা অনেক দূরে সরিয়ে নেন শোভন। বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকেন। নিজেকে স্থির করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। মাথা ঘুরতে থাকে তার। প্রচ  বমি আসতে থাকে। সে বুঝতে পারে কিছু একটা হচ্ছে। শোভন রিকশাওয়ালাকে কাগজটা ফিরিয়ে দেয়। ভীষণ ভয় পায় সে। দ্রুত বাসার দিকে চলে যায় শোভন। বাসায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে শোভন। তবে সে যাত্রায় জানমাল সবই রক্ষা পায় শোভনের।

এদের মতো ভয়ঙ্কর অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে চেতনানাশক ওষুধের বিষে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষজন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় বছরে মেডিসিন বিভাগে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে অসুস্থ হওয়া তিন হাজার মানুষ চিকিৎসা নিয়েছে। মিটফোর্ড হাসপাতালেও একই সময়ে এক হাজার রোগী ভর্তি হয়েছে। এ সময় অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে মারা যাওয়ার সংখ্যাও অনেক। শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশে অভিনব পন্থায় চক্রটি মানুষের কাছ থেকে মালামাল লুটে নিচ্ছে। আসন্ন রমজান মাস সামনে রেখে চক্রটি সক্রিয় হয়ে উঠছে বলে গোয়েন্দাদের কাছেও খবর রয়েছে। পুলিশ বলছে, তারা এমন চক্রের সন্ধানে রয়েছে। ইতিমধ্যে চক্রের অনেক সদস্য গ্রেফতারও হয়েছে।

এরপরও পথ চলতে সাধারণ মানুষকে সচেতন না হলে বার বার এমন চক্রের খপ্পরে পড়তে হবে। যে কারণে সচেতনতার বিকল্প নেই বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অচেতন করার ওষুধে রোগী মারা যেতে পারে বা সারা জীবনের জন্য শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ এটিভেন ট্যাবলেটকে মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে এটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা খাবারে চেতনানাশক মেশাচ্ছে। তারা বেশি ব্যবহার করে এটিভেন, নকটিন ট্যাবলেট ও এপিট্রা নামে একটি তরল ওষুধ। ঘুমের ওষুধ মাইলাম, ডরমিকামও ব্যবহার করে। কখনো কখনো দুর্বৃত্তরা ক্লোরোফর্ম-জাতীয় ওষুধও ব্যবহার করে। এ ছাড়া ডায়াবেটিসের ইনসুলিনও ডাবের পানিতে মেশানো হচ্ছে। এতে ব্লাড সুগার কমে গেলে যে কেউ অচেতন হয়ে পড়তে পারে। এক ফোঁটা এপিট্রা মেশানো খাবার খেলে ৫-১০ মিনিটের মধ্যে ঘুম চলে আসবে। অতিরিক্ত খেলে এই ঘুম দুই থেকে তিন দিনেরও বেশি থাকতে পারে। শারীরিকভাবে দুর্বল ব্যক্তি এসব ক্ষেত্রে মারাও যেতে পারে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর