শনিবার, ১৮ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভিসা যেন সোনার হরিণ

তুচ্ছ কারণে ভিসা প্রত্যাখ্যান হচ্ছে, পাসপোর্ট দিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে দিনের পর দিন

জুলকার নাইন

বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের জন্য ভিসা পেতে ভোগান্তি কমছেই না। নানা তুচ্ছ কারণে বা কোনো কারণ না দেখিয়েই ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে অহরহ। যাদের ভিসা দেওয়া হচ্ছে তারাও শিকার হচ্ছেন ভোগান্তির। বিভিন্ন দেশের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে দিনের পর দিন। অনেক ক্ষেত্রে দরকারের সময়ের পর পাওয়া যাচ্ছে ভিসা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভিসাগুলো স্বল্প মেয়াদের।

জানা যায়, সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে ব্রিটিশ ভিসার ক্ষেত্রে। পাসপোর্ট জমা দেওয়ার পর ফেরত পাওয়ার সময় বেড়ে গেছে। আগের ৭০ ভাগের তুলনায় বর্তমানে ১০ ভাগও মিলছে না ভিসা। আগে ব্রিটেনের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী ব্যক্তির বাংলাদেশ থেকে স্ত্রীকে নিয়ে যেতে সময় লাগত মোটামুটি ছয় মাস। বর্তমানে আইনি প্রক্রিয়া এতই জটিল হয়েছে যে, বছরের পর বছর গড়িয়ে গেলেও মিলছে না ভিসা। ইমিগ্রেশন নীতিমালায় ব্যাপক পরিবর্তন ও কড়াকড়ি আরোপের কারণে অনেক বাঙালির কাছে স্বপ্নের দেশ লন্ডন থেকে যাচ্ছে অধরাই। অথচ যুক্তরাজ্যে অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকরা বসবাস করছেন, এমনকি একাধিক এমপি পদসহ বিভিন্ন পদ-পদবি ধারণ করে আছেন তারা। ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর ইউকে ভিসা প্রসেসিং সেন্টার ঢাকা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরের পর এই ভোগান্তির শুরু।

বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে জটিল আর কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে কানাডার ভিসা পাওয়া। কারণ বাংলাদেশ থেকে কানাডা ভিসা সেন্টার চলে গেছে সিঙ্গাপুরে। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, বায়োমেট্রিক টেস্ট শেষে ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুরে পাসপোর্ট পাঠানো হয়। এরপর শুরু হয় অপেক্ষার পালা। ইতালির ভিসা সেন্টার ঘিরে রয়েছে নানান অভিযোগ। সেখানে গড়ে উঠেছে দালাল চক্র। তারা ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিয়ে ভিসা সাক্ষাৎকারের তারিখ দিচ্ছেন এমন অভিযোগ শোনা যায়। এর বাইরে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে সাক্ষাৎকারের তারিখের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে দশ মাস থেকে এক বছর। ইউরোপের আরেক দেশ পর্তুগালের ভিসার জন্যও বাংলাদেশিদের প্রবল আগ্রহ। কারণ সেখানেও প্রচুর বাংলাদেশি বসবাস করেন। তাদের আত্মীয়স্বজনরা যেতে চান পর্তুগালে। কিন্তু ঢাকায় পর্তুগালের দূতাবাস না থাকায় দিল্লি থেকে ভিসা সংগ্রহ করতে হয়।

সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মতো সহজলভ্য ভিসার দেশগুলোতেও এখন জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। যাচাই-বাছাই কঠোর করা হয়েছে সিঙ্গাপুরের ভিসার ক্ষেত্রে। আগে চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়সূচির প্রমাণ দিলে সহজে ভিসা দেওয়া হতো। এখন চিকিৎসার জন্য ভিসার ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যানের হারও আগের তুলনায় হয়েছে দ্বিগুণ। মালয়েশিয়ার সিঙ্গেল এন্ট্রি ট্যুরিস্ট ভিসা এয়ারলাইনসের রিটার্ন টিকিট এবং কোথায় কত দিন থাকবে তার সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে দেওয়া হলেও মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসার ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অনুরূপ অবস্থা হয়েছে থাইল্যান্ডের ভিসা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও। অথচ থাইল্যান্ডে ভিসা পেতে আগে মোটেও সমস্যা হতো না। সহজেই মিলত ট্যুরিস্ট ভিসা। তবে পরিস্থিতি পাল্টেছে। কখনো কখনো কয়েক মাস লেগে যাচ্ছে সে দেশের ভিসা পেতে। 

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের মতে, সবচেয়ে বেশি ভিসা ভোগান্তিতে পড়ছেন বাংলাদেশি শ্রমিক ও বিদেশ গমনেচ্ছুরা। ভিসা বন্ধ থাকায় আরব আমিরাতে নতুন কোনো শ্রমিক তো যেতেই পারছেন না, অনেক ক্ষেত্রে মানবেতর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে আমিরাত প্রবাসী প্রায় আট লাখ বাংলাদেশিকে। ২০১২ সাল থেকে শুধু বাংলাদেশিদের জন্য আমিরাতে ভিসা বন্ধ রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি, ভারতীয়, নেপালিরা অবাধে ওয়ার্ক ভিসায় সেখানে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আর বাংলাদেশিরা নিজেদের আকামা বা চাকরির ছাড়পত্র পরিবর্তনের সুযোগ এখনো না পাওয়ায় বছরের পর বছর একই বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতেও বাংলাদেশিদের কাজের ভিসা প্রায় বন্ধ। বার বার আশার কথা শোনালেও মালয়েশিয়ার ওয়ার্ক ভিসা বন্ধ। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশ মালদ্বীপ, যে দেশটি এতদিন বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মুখিয়ে থাকত তারাও এখন বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশিদের ‘ওয়ার্ক ভিসা’।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি কয়েকটি দেশে বাংলাদেশিদের নিজেদের মধ্যে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া, একাধিক দেশে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে বাংলাদেশি নাগরিক গ্রেফতারের পাশাপাশি ঢাকার গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনার কিছু নেতিবাচক প্রভাব ভিসার ক্ষেত্রেও পড়েছে। তবে বাংলাদেশের কূটনৈতিক আলোচনা ও অবস্থানের কারণে এ সমস্যা তীব্র হয়নি বলে দাবি করেন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর