সোমবার, ২০ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির ন্যূনতম বয়সের বিধান বাতিল

মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না : হাই কোর্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করে সরকারের জারি করা সব পরিপত্র ও গেজেট অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে হাই কোর্ট। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৮-এর ২(১১) ধারা অনুযায়ী সরকার কর্তৃক বয়সসীমা নির্ধারণের বিধানকেও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে রায়ে। এ ছাড়া আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের বকেয়াসহ বন্ধ থাকা সম্মানী ভাতা পরিশোধ বা চালু করতে বলেছে আদালত। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে তা কার্যকর করতে বলা হয়েছে। গতকাল বয়সসীমা নির্ধারণের পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে ১৫টি রিট আবেদনে দেওয়া রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। আদালতে আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এম আলতাফ হোসেন, ওমর সাদাত, ইউনুছ আলী আকন্দ, মো. জাহাঙ্গীর জমাদ্দার, নারগিস তানজিমা, সেলিনা আক্তার চৌধুরী, শরীফ আহমেদ, শুভ্রজিত ব্যানার্জি এবং এ আর এম কারুজ্জামান কাঁকন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, পৃথিবীর কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের ফ্রেমে বাঁধা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ মানুষ আবেগ দিয়ে করে, দেশপ্রেম থেকে করে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বয়স, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যোগ দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। ফলে মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে বয়স কোনো কারণ নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদাহরণ টেনে আদালত পর্যবেক্ষণে বলে, সাত-আট বছর বয়সী যোদ্ধারা সে সময় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। বাংলাদেশে বই, সিনেমা আছে শিশু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। তাই বয়সের ফ্রেমে বেঁধে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না। ঐতিহাসিক দলিল, প্রমাণের ভিত্তিতেই মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। বীরপ্রতীক শহিদুল ইসলাম লালুর উদাহরণ টেনে আদালত পর্যবেক্ষণে আরও বলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে ১০ বছর বয়সী শহিদুল ইসলাম লালুকে বীরপ্রতীক খেতাব দিয়েছেন, সেখানে সরকার কীভাবে আবেদনকারীদের ১০ বছর বয়সী কিংবা অমুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করে। লাল মুক্তিবার্তার বাইরেও অনেক সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা আছেন। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা পরিবর্তনের কোনো আইনগত এখতিয়ার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে দেওয়া হয়নি। রায় ঘোষণার একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ।

রায়ের মধ্যে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাটি পড়ছিলেন। এরপর হঠাৎ একটু থেমে যান এ বিচারপতি। তারপর বলেন, ‘আমি একটু ইমোশনাল হয়ে গেছি। আমার মনে হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চ ভোরবেলার দেওয়া স্বাধীনতার এ ঘোষণাটি পড়লে যে-কেউই আবেগপ্রবণ হয়ে যাবে।’ এ সময় বারবার চোখ মোছেন বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ। এ দৃশ্যপটের অবতারণা হলে রিটের পক্ষের আইনজীবীরা দাঁড়িয়ে যান।

রায়ের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য বয়স-সংক্রান্ত যেসব গেজেট ও পরিপত্র রয়েছে, সবই বাতিল করেছে হাই কোর্ট। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৮-এর ২(১১) ধারা অনুযায়ী সরকার কর্তৃক বয়সসীমা নির্ধারণের বিধানকেও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে রায়ে। আদেশের পর রিটকারীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর সাদাত বলেন, যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়ে আসছিলেন, কোনো রকম কারণ দর্শানোর নোটিস ছাড়াই তাদের ভাতা বন্ধ করে দিয়ে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের বয়স ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১২ বছর ৬ মাস হয়নি, তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন না। আদালত এ নিয়ে অত্যন্ত উষ্মা প্রকাশ করেছে। ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর যে পরিপত্রটি জারি করা হয়, পরবর্তীতে সেটিই ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর ‘মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও বয়স নির্ধারণ’ করে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। ওই গেজেটে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত ন্যূনতম ১৩ বছর হতে হবে। এরপর ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি আরেকটি গেজেটের মাধ্যমে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর জারি করা গেজেটে বয়স প্রতিস্থাপন করে ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম বয়স ১২ বছর ৬ মাস করা হয়। এই দুটি গেজেট ও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৮-এর ২(১১) ধারা অনুযায়ী সরকার কর্তৃক বয়সসীমা নির্ধারণের ধারার আংশিক চ্যালেঞ্জ করে ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধারা হাই কোর্টে পৃথক ১৫টি রিট অবেদন করেন। ওই সব রিটে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে গতকাল এ রায় দিল উচ্চ আদালত।

সর্বশেষ খবর