বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে

আকাশ ও নৌপথে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে, বাংলাদেশি পাসপোর্টে গিয়ে ভাবমূর্তি নষ্ট করছে

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে

এখানকার কোনোরকম নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করছে না কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা। প্রতিনিয়ত ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচে-কানাচে। উখিয়া-টেকনাফের ত্রিশটি ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়া এসব রোহিঙ্গা এখন প্রতিদিন ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছেন। বড় একটি অংশ শিকার হচ্ছেন পাচারের। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে থাকা শতাধিক রোহিঙ্গা আটকের খবর পাওয়া গেছে।

এ ছাড়া বিদেশে পাচারকালে মহেশখালী, বাঁশখালী ও শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়েছে আরও অন্তত শতাধিক রোহিঙ্গা। এর আগেও বহুবার দেশের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বেড়ানো অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে আটক করা হয়েছে। মূলত কাজের সন্ধানে এবং আরও উন্নত জীবন যাপনের আশায় ক্যাম্পের জীবন থেকে মুক্তি পেতে তারা পালাচ্ছে। স্থানীয় দালাল চক্রের সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বিদেশ পাড়ি দিতে কৌশলে ক্যাম্প ছেড়ে যাচ্ছে। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গারা মাঝেমধ্যে আটক হলেও দালালরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। গত ৪ এপ্রিল কুড়িগ্রামে পাসপোর্ট করতে গিয়ে দালালসহ ৪ রোহিঙ্গা নারী আটক হয়েছেন। ১৪ মে পুলিশ এবং কোস্ট গার্ড সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তুতিকালে টেকনাফ এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপে ৮৪ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। এদের মধ্যে ৬৭ জনকে আটক করেছে পুলিশ এবং ১৭ জনকে আটক করেছে কোস্ট গার্ড। ধরা পড়েছে পাচারকারী চক্রের ৫ সদস্যও। জানা গেছে, রোহিঙ্গারা যাতে দেশের মূল জনস্রোতে মিশে যেতে না পারে সে জন্য টেকনাফ থেকে উখিয়া পর্যন্ত বসানো হয়েছে বেশ কয়েকটি চেকপোস্ট। পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এসব চেকপোস্টে তল্লাশি চালান। রোহিঙ্গাদের অবাধ যাতায়াত রোধ করতে স্থানীয়দের যাতায়াতের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে চলাচল করতে হয়। এত সতর্কতা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের নানা প্রান্তে। জড়িয়ে পড়ছে সামাজিক ও অসামাজিক পেশায়। প্রতিদিন ভোরে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের অনেকে কাজের সন্ধানে ক্যাম্প থেকে বের হন। সন্ধ্যা বা রাতে কেউ ফেরেন কেউ ফেরেন নাÑ এমনটাই জানালেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। যারা ফিরে আসেন না তারা দূরপাল্লার কোনো বাসে বা ট্রাকে চেপে বসেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্য টাকার বিনিময়ে তাদের বাইরে যেতে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অরক্ষিত ক্যাম্পগুলোতে ন্যূনতম কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কথা থাকলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তাদের নিজেদের কিছু লোক এবং স্থানীয় কিছু বাঙালি মিলে ক্যাম্প ছাড়ার ইন্ধন দিয়ে থাকে। তারা দেশের ভিতরে ভালো বেতনের চাকরি ও কম টাকায় বিদেশে গিয়ে উন্নত জীবন ধারণের প্রলোভন দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে বের করে। এতে কেউ কেউ নিজেদের জমানো টাকা-পয়সা ও সহায়-সম্বলের বিনিময়ে চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। প্রতারিত হয়ে আটকের পর শূন্য হাতেই তাদের আবার ক্যাম্পে ফিরতে হচ্ছে। দালাল চক্র মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, জাপান ও শ্রীলঙ্কায় ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এদের খপ্পরে পড়ে অনেক রোহিঙ্গা দ্বিতীয়বারের মতো নিঃস্ব হচ্ছে। আবার কোনো কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে গিয়ে নানা অপরাধকর্মে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এতে শ্রমবাজারে বাঙালিদের সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, গত কয়েক দিনে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১৭১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। এই রোহিঙ্গাদের নিজ নিজ ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কক্সবাজারের বাইরে কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকার খিলক্ষেত থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ২৩ রোহিঙ্গাকে আটক করেন। দালাল চক্রের মাধ্যমে ক্যাম্প ছেড়ে রাজধানীতে ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা। আটক রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছিল বলে জানান তিনি। ওসি নুরুল ইসলাম জানান, উখিয়াতেই চারটা চেক পোস্ট রয়েছে। কাউকে বের হতে হলে ৪টার মধ্যে তিনটা চেক পোস্টেই পড়তে হয়। তার পরও রোহিঙ্গারা নানা কৌশলে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। ২ দিন আগেও দুজন দালালকে আটক করে মামলা দেওয়া হয়েছে। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা এখন প্রকাশ্যে চলাফেরা করেন। চলাচলে কোনো বাধা নেই। এখন কক্সবাজার জেলাজুড়ে তাদের অবাধ বিচরণ। এর পরিধি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। পুরো বাংলাদেশটাই তারা তাদের বাপ-দাদার বলে মনে করছে। এটা উদ্বেগজনক। উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সীমানা প্রাচীর দিতে হবে। নইলে তারা অচিরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে অনেকে ক্যাম্প ছেড়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে নাগরিকত্ব সনদও গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার সময় সরকারের পক্ষ থেকে হোটেল, রাস্তা, যানবাহনে সার্বক্ষণিক নজরদারি ও তল্লাশির ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা অনেকটাই শিথিল।

সর্বশেষ খবর