বুধবার, ২৯ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা
উদ্বেগজনক বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা

নবজাতক হত্যা, বৃদ্ধ থেকে শিশুধর্ষণ ঘটছে হরহামেশা

জিন্নাতুন নূর ও শামীম আহমেদ

নবজাতক হত্যা, বৃদ্ধ থেকে শিশুধর্ষণ ঘটছে হরহামেশা

বয়সের ভারে ন্যুব্জ স্বদেশী সাহা। ঠিকমতো চলাচলও করতে পারেন না। চার ছেলেকে আদর যতেœ যে মা বড় করলেন, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই ছেলেরা কেউ আর সেই মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে রাজি নন। শেষ পর্যন্ত ছেলেদের মধ্যে মনীষ সাহা ও স্বদেশীর নাতি তাকে রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যান। গত ২১ মে ফেনী শহরের মাস্টারপাড়া এলাকায় হৃদয় বিদারক এই ঘটনাটি ঘটে। স্বদেশী একা নন, সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এমন করুন পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে দেশের অসংখ্য বৃদ্ধ বাবা-মাকে। আশ্রয় হচ্ছে সড়কে, রেলস্টেশনে বা বৃদ্ধাশ্রমে। সম্প্রতি টাঙ্গাইলে মধুপুর উপজেলায় শত বছরের এক অন্ধ বৃদ্ধার ঘরে ঢুকে তার মুখ বেঁধে ধর্ষণ করে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর। অন্যদিকে মিরপুরের রূপনগর এলাকায় চাচার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের জেরে গর্ভে আসা সন্তানকে পাঁচতলা বাসার টয়লেটের ভেন্টিলেটর দিয়ে নিচে ফেলে দেয় এসএসসি পাস এক কিশোরী মা। তদন্তে নেমে মৃত ভ্রƒণটির মাকে খুঁজে পায় পুলিশ। বেরিয়ে আসে চাচার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের কথা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং গণমাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী ঢাকাসহ সারা দেশে মানব ভ্রƒণ হত্যা, পরিজনের হাতে পরিজন খুন, ধর্ষণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্ষকের বিকৃত লালসার শিকার হচ্ছে শত বছরের বৃদ্ধা থেকে দুই বছরের দুধের শিশুও। কখনো সন্তানকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করছেন হত্যাকারী মা-বাবা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নৈতিকতা, মানবিকতা এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়, আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা, অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা, বিকৃত টিভি সিরিয়াল, সামাজিক মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাবে এসব অপরাধ বাড়ছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে মোট ২০টি পরিচয়বিহীন মানব নবজাতক পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১২টিই ছিল মৃত। এগুলোর কোনোটি মিলেছে রাস্তায়, কোনোটি হাসপাতালে, কোনোটি আবার ময়লার স্তূপে। রাজধানীর রামপুরায় উলন রোডে ময়লার স্তূপ থেকে একদিন বয়সী মৃত মানব নবজাতক উদ্ধার হয় গত ২৩ মে। স¤প্রতি রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার শিশু হাসপাতালের টয়লেটে পাওয়া যায় তিন দিন বয়সী আরেকটি নবজাতক। কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের ৪২৬ নম্বর রুমে এক অবিবাহিত ছাত্রী সন্তান প্রসবের পর তা ট্রাঙ্কের ভিতর লুকিয়ে রাখে। পরে নবজাতকটির কান্নার শব্দে শিক্ষার্থীরা ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে শিশুটিকে উদ্ধার করলেও আর বাঁচানো যায়নি। ধর্ষণের চিত্র আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী, চলতি জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে মোট ২৮৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। শুধু এপ্রিল মাসেই ধর্ষিত হয় ১২২ শিশু। গণধর্ষণের শিকার হয় ৩৫ জন। এর মধ্যে ১৪টি প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণ শেষে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয় ১৬ শিশুকে। বাড়ছে স্বজনের হাতে স্বজন হত্যার ঘটনাও। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০টি শিশু বাবা-মায়ের হাতে খুন হয়। সম্প্রতি নরসিংদীর কাউরিয়া পাড়ায় অভাবের তাড়নায় শফিকুল ইসলাম নামের এক বাবা তার দুই শিশুকন্যাকে হত্যা করেন। জিজ্ঞাসাবাদে ওই বাবা জানান, মেয়েদের ভরণপোষণ দিতে না পেরে তিনি নিজের দুই কন্যাকে হত্যা করেছেন। এ ছাড়া যশোরের শার্শায় চা-দোকানি ইব্রাহিমের স্ত্রী হামিদা খাতুন (৩৫) ঈদে সন্তানদের নতুন পোশাক কিনে দেওয়ার জন্য স্বামীর সঙ্গে কলহের পর এক পর্যায়ে দুই সন্তানকে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেন। পরে নিজেও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালমা আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অপরাধের জন্য তিরস্কার ও ভালো কাজের জন্য পুরস্কার করতে পারলে অপরাধ কমত। এখানে হয় উল্টো। ধর্ষক ঘুরে বেড়ায়, ধর্ষিতকে একঘরে করা হয়। পরিবারসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগে নৈতিকতা শেখাত। এখন এই প্রতিষ্ঠানগুলো অকেজো হয়ে গেছে। অপরাধ কমাতে সামাজিক স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করতে হবে। অপরাধীকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ছাড় দেওয়ার সংস্কৃতি বদলাতে হবে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তানের হাতে মা-বাবা আর অভিভাবকের হাতে সন্তান হত্যার পেছনে আর্থিক কারণ জড়িত। অনেকক্ষেত্রে অভিভাবকরা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছে। এই সম্পর্কের পথে বাধা পেলে হত্যার ঘটনা ঘটাচ্ছে। পরিবারের বড়রা নিজেদের পেছনে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে শিশুদের খোঁজ রাখছে না। নিজের ও পরিবারের চাহিদা মেটাতে মানুষ দিনরাত ছুটছে। এতে পরিবারের মধ্যে যে সুসম্পর্ক থাকার কথা, একসঙ্গে সময় কাটানোর কথা, নৈতিকতার চর্চা হওয়ার কথা সেগুলো হচ্ছে না। এতে পারিবারিক সহিংসতাগুলো বাড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পারিবারিক মূল্যবোধের ঐতিহ্যবাহী সমাজব্যবস্থা থেকে আমরা আধুনিক সমাজে পা দিচ্ছি। সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের মাঝামাঝি অবস্থান করছি। এই সময়ে সমাজে নানা ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্রে সমাজ পরিবর্তনের সময়ও হয়েছিল। সমাজে এখন অবারিত স্বাধীনতা। ছেলে-মেয়েদের সম্পর্কের ধরণ বদলে গেছে। খুন, ধর্ষণ আগেও ছিল, তবে এত নির্মমতা ছিল না। পর্নোগ্রাফির বিষবাষ্প প্রতিটি শ্রেণিকে আঘাত করছে। আগেকার সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক রীতিনীতি ও পারিবারিক বন্ধনগুলো এসব অপরাধ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখত। সমাজ পরিবর্তনে অনুশাসনগুলো হালকা হয়ে গেছে। সঠিক কাউন্সিলিং এসব অপরাধ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া খুন, ধর্ষণ বন্ধে সময়ের প্রয়োজনে অনেক আইন হলেও প্রয়োগ সেভাবে হয় না। আইনের কঠোর বাস্তবায়ন হতে হবে।

সর্বশেষ খবর