বুধবার, ২৯ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

জুমের আগুনে জ্বলছে পাহাড়

ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা

মানিক মুনতাসির, পার্বত্য এলাকা থেকে ফিরে

জুমচাষিদের লাগানো আগুনে দেদারসে পুড়ছে পাহাড়। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাতের আঁধারে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাহাড় থেকে পাহাড়ে। এমনকি দিনের বেলায়ও গহিন পাহাড়ে আগুন লাগানো হচ্ছে। একদিকে খরা, অন্যদিকে জুমের আগুনে পুড়ছে পাহাড়ের গাছপালা, পশুপাখি আর জীববৈচিত্র্য। এতে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির পথে এগোচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পাহাড়ি অঞ্চলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, পার্বত্য অঞ্চলে জুম চাষের জন্য শত শত পাহাড় পুুড়িয়ে দিচ্ছেন পাহাড়িরা। এতে পাহাড়ের গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সাপ, পোকামাকড়সহ বিভিন্ন ধরনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, যা পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। খাগড়াছড়ির বাঘাইছড়ি, মানিকছড়ি, দীঘিনালার বিস্তীর্ণ বনভূমি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধু ন্যাড়া পাহাড়গুলো। এতে বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ের মাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে। যার ফলে পাহাড়ধসের ঘটনাও বাড়ছে। এতে কোথাও কোথাও পাহাড়ি মানুষদেরও পুড়ে মরা এবং মাটিচাপা পড়ে নিহত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে বলে জানা গেছে। এভাবে বছরের পর বছর পাহাড়ে আগুন দিয়ে জুম চাষের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণিজ সম্পদ। জুমিয়া পরিবারগুলো পাহাড়ে আগুন দিয়ে আদি পদ্ধতিতে জুম চাষ করে সারা বছরের খাদ্যশস্য ঘরে তুলতে পারলেও জুম চাষ প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপন্ন করার পাশাপাশি মাটি ক্ষয় এবং প্রাণিজ সম্পদের আশ্রয়স্থল ধ্বংস করে দিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিভাগের কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, প্রতি বছর অন্তত ২৫ হাজার হেক্টর পাহাড়ি জমিতে জুম চাষ করে থাকেন এসব এলাকার অধিবাসীরা। অথচ সরকারের কৃষি বিভাগ থেকে জুম চাষের বিকল্প হিসেবে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এসব অঞ্চলে। কিন্তু তা গ্রহণ না করে আদি পদ্ধতি হিসেবে পাহাড় পুড়িয়ে জুম চাষ করছেন পাহাড়িরা। জানা গেছে, প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে জুমিয়ারা পাহাড়ে আগুন দেয় এবং মে-জুন মাসের দিকে আগুনে পোড়ানো পাহাড়ে জুম চাষ শুরু করে। চিম্বুক সড়কের পাহাড়ের বাসিন্দা লিংরিয়ান মুরং এবং ডলুপাড়ার বাসিন্দা চথোয়াই মারমাসহ কয়েকজন জুম চাষি জানান, পাহাড়ে জুম চাষ তাদের পূর্বপুরুষের আদি পেশা। তারা জুম চাষের মাধ্যমে সংসার চালান এবং সারা বছরের খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করেন। জুমে পাহাড়ি ধান, ভুট্টা, মরিচ, যব-সরিষা, মিষ্টিকুমড়া, মারমা, টকপাতা, আদাসহ বিভিন্ন মসলা ও সবজি চাষ করেন তারা। জুম চাষের মাধ্যমে অধিকাংশ পাহাড়ি পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। বাংলাদেশ মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ্র জানায়, জুম চাষ পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। জুম চাষের জন্য যে হারে পাড়া পোড়ানো হয়, তাতে একসময় ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি জেলার জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার সব সময় জুম চাষকে নিরুৎসাহিত করে আসছে। এ জন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের চাষাবাদের আধুনিক পদ্ধতির বিষয়ে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন।

সর্বশেষ খবর